আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির আন্দোলনের চেয়েও সরকার ও মানুষের বেশি নজর ছিল মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের ওপর। বলতে গেলে বিএনপিও নজর রেখেছিল এই দল সফর শেষ করে কী বলে তার ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের দুই দল রিপাবলিক ও ডেমোক্রেটিক পার্টির থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত আইআরআই ও এনডিআইয়ের সমন্বয়ে গঠিত এই প্রতিনিধিদল কথা বলেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে। কথা শুনে গিয়ে যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেটা বড় কোনো আলোচনার জন্ম দেয়নি, যতটা প্রত্যাশা ছিল। ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে তারা বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক ও অহিংস নির্বাচনের জন্য অগ্রগতির রোডম্যাপ হিসেবে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে। এই পাঁচ দফার মধ্যে আছে—রাজনৈতিক নেতাদের সহনশীল বক্তব্য, নির্বাচনী ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফলপ্রসূ সংলাপ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা এবং ভিন্নমতকে সম্মান করা। একই সঙ্গে স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা এবং নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নির্বাচনে অংশগ্রহণের সংস্কৃতি তৈরি করাসহ সব দলকে অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পরিবেশ তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে।
একটা ভিন্ন দেশ থেকে যখন আমার দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সহনশীল বক্তব্য দেওয়ার তাগিদ আসে তখন নাগরিক হিসেবে আমাদের কষ্ট লাগে। সহনশীল, রুচিশীল বক্তৃতা দেওয়ার নসিহতও আমাদের নেতাদের নিতে হয়? এই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি? সংলাপের কথা যখন সুপারিশ হিসেবে আসে, সেটাও কি লজ্জার নয়?
সংলাপের তাগিদটা শুধু এই মার্কিন প্রতিনিধিদলই নয়, দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও। দেশের ভেতর থেকেও এ অনুরোধটা এসেছে। মানুষ সংঘাতের পরিবর্তে সংলাপ চায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে এত কথা দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে এমনভাবে হয়নি, যা এখন হচ্ছে। তাই বর্তমানের বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নতুন করে চিন্তা করার সময় এসেছে।
সংলাপ, কথাবার্তা রাজনীতিতে পরিচিত শব্দ, রাজনৈতিক কাজকর্মের অঙ্গ। কিন্তু সংলাপী রাজনীতি, অন্যের মতামত গ্রহণ করার মানসিকতা নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা ভাবেন না। যে দল যখন ক্ষমতায় আসছে, সে তখন একতরফা রাজনীতি করতে চেয়েছে। অসংলাপী রাজনৈতিক আচরণ এবং সমাজকে কুক্ষিগত করে তার বহুত্বকে গ্রাস করার কুফল দেখতে দেখতে এখন সমাজের সব স্তরেই কথোপকথনের রাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা এসেছে। দুঃখজনক যে, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলীয় হুকুম, শাসক এবং আদেশের স্থান আছে, কথাবার্তার স্থান নেই। এটা একদিক থেকে নয়। বিবদমান পক্ষ যখন যার যার অবস্থান ও শর্তে অবিচল থাকে, তখন উচ্চারিত হয় কার সঙ্গে কথা বলব? কত মত শুনব? কত উপায় ভাবব? কতদিন শুনব? আমাদের বর্তমান অবস্থানটা সেখানেই আটকে আছে। বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কেউ কাউকে আস্থায় নিতে পারছে না। বিদ্বেষ আর বিভাজনের চর্চায় সংলাপহীন রাজনীতি যে পত্রপুষ্পহীন, প্রাণহীন, রসদহীন এক কঙ্কাল, সেটা আমাদের রাজনীতিবিদরা বুঝতেই পারছেন না। রাজনৈতিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক নির্বাচন-পূর্বকালে দেশে বড় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে চরম অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতির চাপে জনজীবনে নাভিশ্বাস, অন্যদিকে সহিংস রাজনীতির শঙ্কায় মানুষ ভীত। এমন অবস্থায় সবার কাছে রাজনৈতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানই প্রত্যাশিত। আমার তো মনে হয় বেশ কিছু সুযোগও তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে বিদেশিরা যখন আসে, বিবদমান দলের নেতারা গিয়ে তাদের সামনে গিয়ে এক টেবিলে বসেন। তাহলে নিজেরা কেন পারেন না? সেদিকে নজর ফেরানো দরকার। দরকার সংলাপের জন্য স্বচ্ছ ভাবনা, নতুন পথে চিন্তা করতে শেখা।
যে রাজনীতিবিদরা এখন একে অন্যের সঙ্গে কথাবার্তায় চূড়ান্ত অনীহা দেখাচ্ছেন, অসহিষ্ণুতাকে তাদের রাজনীতির প্রধান চিহ্ন করে তুলছেন, তাদের রাজনৈতিক শৈশব আর যৌবন কেটেছে রাজনৈতিক কথাবার্তাতেই। তাহলে কী বলবে যে, কথাবার্তার রাজনীতির ঐতিহ্য একেবারে শেষ হয়ে গেছে?
সংলাপ, কথোপকথন যদি না হয় তাহলে কী করবে আমাদের রাজনীতি? শাসক দল আওয়ামী লীগ একেবারে স্থির যে, নির্বাচন নিয়ে সংবিধান বা প্রচলিত আইনে যা আছে, তার বাইরে কোনো সংলাপ হতে পারে না। অন্যদিকে বিএনপিও স্থির যে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে রেখে কোনো সংলাপ হবে না। কিন্তু সরকারকে অবৈধ বললেও সংলাপটা তার সঙ্গেই করতে হবে, এ ভাবনাটা আসতে হবে বিএনপির ভেতর।
কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগও স্বস্তিতে নেই। সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। দেশের ভেতরে অস্থিরতা ও সহিংসতার আশঙ্কা ছাড়াও বাইরের চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক। এর মধ্যেই নির্বাচন ঘিরে ভিসা নীতি ঘোষণা ও প্রয়োগ করতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল দেশটি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে জানিয়েছে, ইইউ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। ক্ষমতাসীনদের সামনে এগুলো অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর আমেরিকার ভিসা নীতি ঘোষণায় সব মহলে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া আছে। এ ধরনের উদ্বেগ আগে কখনো দেখা যায়নি।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের নিজস্ব প্রতিশ্রুতি। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করার কথা দলপ্রধান এবং দলের সব নেতা বলছেন। যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি না আসে, তাহলে ২০১৪ সালের মতো একটি নির্বাচন করে শাসনকাজ সামলে নিতে পারবে আওয়ামী লীগ?
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতির সঙ্গিন অবস্থা। মানুষের জন্য বড় সংকট হয়ে এসেছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। ডিম থেকে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল, চিনি কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণে নেই। মানুষ বিশ্বাস করে, মন্ত্রীরাও বলেন যে, সিন্ডিকেটের কারসাজিতে দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ডলার সংকটে আমদানি-রপ্তানি বলতে গেলে বন্ধের পর্যায়ে আছে। বিরোধী দলকে দমানো যাবে, নির্বাচনও হয়তো করে ফেলা যাবে, কিন্তু অর্থনীতির সংকট থেকে বের হওয়া যাবে?
আওয়ামী লীগের আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দলীয় কোন্দল। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় শাসক দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা, আধিপত্য বিস্তার, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন নিয়ে সারা দেশে কোন্দল ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে কর্মীরা মারামারি আর খুনোখুনিতে লিপ্ত প্রায় প্রতিটি জনপদে। অন্যদিকে বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ আন্দোলন সফলের। সরকার পতনের লক্ষ্যে দলটির একদফা দাবি আন্দোলনের বেশ কিছু ঘোষিত চূড়ান্ত পর্বের শেষটি ছিল এই অক্টোবরে। সেটিও প্রায় যায় যায়। আন্দোলন ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই বলে জানাচ্ছেন দলটির নেতারা। বলছেন, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের শেষ ধাপে এখন তারা। লক্ষ্য ঢাকাকে অচল করে দেওয়া। ষোলো বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির এবার আন্দোলন সফল করতে পারাই এখন লক্ষ্য। কারণ এবারও বিএনপিকে ছাড়া সরকার যদি নির্বাচন করতে পারে, তাহলে দলটি আরও সংকটে পড়তে পারে। এ বিষয়টি বিএনপির নেতৃত্বও বিবেচনায় নিচ্ছে বলে দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন। তাই আগামী দিনে আন্দোলন সফল করাই বিএনপির বড় প্রচেষ্টা। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই দীর্ঘ সময় থাকায় আওয়ামী লীগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে শক্তভাবে সাজিয়েছে। কোন্দল থাকলেও মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ প্রচণ্ড শক্তিশালী দল।
আগামী মাস, অর্থাৎ নভেম্বরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করতে চায় নির্বাচন কমিশন। লক্ষ্য আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের শুরুতেই নির্বাচন করে ফেলা। আর তাই তপশিল হওয়ার আগেই রাজপথে একদফা আন্দোলনের ফয়সালা করতে চায় বিএনপি নেতৃত্ব। কারণ তারা ভালোভাবেই জানে, একবার নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করলে প্রান্তিক মানুষকে আন্দোলনে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে কোনোভাবেই জেদাজেদির স্থান নেই। কিন্তু সেটাই চলছে। জেদ জয় হলে মানুষ হেরে যায়।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন