নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য উপন্যাস। সাতচল্লিশের দেশ ভাগকে কেন্দ্র করে লেখা অসাধারণ মানবিক এক দলিল এটি। দেশ ভাগের পটভূমিতে সোনাদের পরিবার চলে গেল ওপার বাংলায়। দেশ, ভিটেমাটি, সোনালি বালুর চর, সেই কিংবদন্তির খাল, যেখানে ফি বছর একটা করে মানুষ ডুবে মরে, বাল্যবন্ধু ফতিমা আর খেলার সাথী ঈশম চাচা—সবকিছু ছেড়ে। পূর্ববাংলা থেকে চলে গেল হাজারও হিন্দু পরিবার নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে। কিন্তু নীলকণ্ঠ পাখি যে কী, সবাই খুঁজে চলেছে এ পাখি। কারও কাছে নীলকণ্ঠ পাখি নারী, কারও কাছে স্বামীসুখ, কারও কাছে দুবেলা দুমুঠো অন্ন, আবার কারওবা স্বাধীনতা। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার নাম নীলকণ্ঠ পাখি, যাকে পাওয়ার জন্য সে সারা জীবন ঘুরে ঘুরে মরে। কিন্তু পায় না। অথচ অস্তিত্বহীন এ পাখির খোঁজেই মানুষের পথচলা। ঢাকা জেলার হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত রাইনাদী গ্রামের মানুষের জীবনযাপন নিয়েই এগিয়েছে উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ। ধর্ম তাদের ভিন্ন, ধনী-গরিব ফারাকও আছে বেশ। কিন্তু উৎসব-পার্বণে মেতে ওঠে সবাই। আর তাই ঠাকুরবাড়ির ঢাকের বাজনায় দূরগ্রামে শ্বশুরবাড়িতে আনচান করে ওঠে মুসলমান ঘরের মেয়ে জোটনের মন। সেবারের বর্ষায় ঠাকুরবাড়ির সেজোঠাকুর চন্দ্রনাথের ছেলে হলো—নাম তার সোনা। পরিবারের ছোট ছেলে হওয়ায় সবার বড় আদরের সে। সোনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তার বড় জ্যাঠামশাই মণীন্দ্রনাথ, যিনি পিতৃসত্য পালনে পাগল বনে গিয়েছিলেন। সোনার মা, জেঠিমা, লাল্টু, পল্টু, ছোট কাকা শচীন্দ্রনাথ, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা সব নিয়ে একান্নবর্তী পরিবারের সেই চিরায়ত ছবি। গোপাটের ওধারে নরেন দাসের তাঁতঘর। নরেন দাসের বিধবা বোন মালতী, যার স্বামী মারা গেছে ঢাকার দাঙ্গায়। এদিকে মুসলমানপাড়ায় রয়েছে সামসুদ্দীন, সবাই ডাকে সামু। সামু জড়িয়ে পড়ছে মুসলিম লীগের সক্রিয় রাজনীতিতে। রয়েছে আবেদালি যে রুটি-রুজির জন্য করে দিনমজুরি। অভাবের সংসার। ভাতের অভাবে বেশিরভাগ দিনই আবেদালির স্ত্রীকে জালালি বিলের শাপলা শালুক সিদ্ধ করে খেয়ে খিদে মেটাতে হয়। আবেদালির অবাধ্য ছেলে জব্বার। কাবাডি খেলায় কসরত দেখিয়ে যে নাম করেছে সে ফেলু শেখ, সবাই ডাকে ফ্যালা। ফ্যালা এক ছেলে বটে! দিনদুপুরে এক ব্যবসায়ীর গলায় পোঁচ মেরে তুলে এনেছে তার বিবিকে। গয়না নৌকার মাঝি ঈশম শেখের কথা বলতেই ভুলে গেছি। সে মুসলমানপাড়ায় পঙ্গু স্ত্রীকে নিয়ে থাকে বটে, কিন্তু ঠাকুরবাড়ির চাকর হওয়ায় তাকে সবাই বলে বিধর্মী। মাটির গন্ধ লেগে রয়েছে রাইনাদী গ্রামের আনাচে-কানাচে। আর রয়েছে নানা রূপকথা। কিন্তু হঠাৎই কোত্থেকে ধর্মকে পুঁজি করে একদল লোক নেমে পড়ল বিদ্বেষ ছড়াতে। পরপর বেশ কয়েকটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধল আশপাশের গ্রামগুলোতে। কেউ বলে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, কেউ বলে বন্দে মাতারম। সব ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একদিন ঈশম শেখের তরমুজের মতো করে সোনার দেশকে করা হলো টুকরো টুকরো। অ্যাট লাস্ট দ্য সেলফিশ জায়ান্ট কেম! স্বার্থপর দৈত্য যে আর কিছুই নয়, সে স্বাধীনতা।
উপন্যাসটিকে বলা হয়ে থাকে এ উপমহাদেশের বিবেক। দেশ ভাগের প্রেক্ষাপটে বাংলার দুই সম্প্রদায়ের মানুষের আবেগ-অনুভূতি, অপ্রাপ্তি আর আত্মিক সম্পর্কের পারস্পরিক বন্ধনের দলিলের নাম ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’।
মন্তব্য করুন