রবিবার, ২৪ আগস্ট ২০২৫, ৯ ভাদ্র ১৪৩২
মাইকেল কুগেলম্যান
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৩, ১০:৩২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভারত-মার্কিন সম্পর্ক বন্ধুত্বের না শত্রুতার

ভারত-মার্কিন সম্পর্ক বন্ধুত্বের না শত্রুতার

ভারত-মার্কিন সম্পর্ক মূলত একটি কৌশলগত অংশীদারত্বের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এ সম্পর্কের শুরুটা ছিল ২০০৮ সালে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই। উভয় দেশের এই চরিত্রায়ন অবশ্যই উপযুক্ত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কৌশলগত অংশীদারত্ব বলতে আসলে কী বোঝায়? ওয়াশিংটনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাষ্ট্রীয় সফর একটি অংশীদারত্বের সুযোগ দেয়। ফলে উভয় দেশের সম্পর্ক নানা রকম লেনদেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জোটের মধ্যে একটি মাঝারি মানের স্থান দখল করে। তবে যৌক্তিক দিক থেকে এ ব্যাপারটি কখনোই অতটা শক্তিশালী ছিল না।

যে ব্যাপারগুলো মনে রাখতে হবে: সাধারণত একটি কৌশলগত অংশীদারত্বকে উচ্চ স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সহযোগিতা এবং বুদ্ধিমত্তা আদান-প্রদান, সহযোগিতার বহুমুখী মাত্রা, ব্যাপক রাজনৈতিক সমর্থন এবং সার্বিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে অনুসরণ এবং উপলব্ধি করা যায়।

সুতরাং, মার্কিন-ভারত সম্পর্কের সঙ্গে উপরোল্লিখিত পয়েন্টগুলো মিলিয়ে দেখা উচিত। উভয় দেশের মধ্যে অস্ত্র বিক্রি, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং নানা রকম সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি মার্কিন গোয়েন্দারা নয়াদিল্লিকে উত্তর সীমান্তে বিভিন্ন হুমকি পর্যবেক্ষণ করতেও সহযোগিতা করেছে।

বর্তমানে সহযোগিতার দ্রুত বৈচিত্র্যময় আরও বেশ কয়েকটি উদাহরণ হচ্ছে প্রযুক্তিগত সহায়তা, মহাকাশ, ক্লিন এনার্জি এবং উচ্চশিক্ষা। তা ছাড়া এ ধরনের অংশীদারত্ব উভয় দেশেই বহুদলীয় সমর্থন উপভোগ করে এবং কয়েক বছর ধরে এ ধরনের অংশীদারত্ব বড় ধরনের কোনো সংকটের সম্মুখীন হয়নি।

তবে সমালোচকদের যুক্তির অভাব নেই। তারা যুক্তি দেবেন যে, মার্কিন-ভারত নিরাপত্তা অংশীদারত্ব অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের আনুষ্ঠানিক মিত্র হতে নারাজ। সত্য হচ্ছে, ওয়াশিংটন এ ধরনের সম্পর্ককে একীভূত হওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে না। এ ধরনের সম্পর্ক পরিপূর্ণ নয়, আংশিক। কারণ এ ধরনের অংশীদারত্ব আসলে কিছু আন্তর্জাতিক জোটের মতো রূপ ধারণ করেছে।

নয়াদিল্লির সঙ্গে ওয়াশিংটনের যে মৌলিক প্রতিরক্ষা চুক্তি, তা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শীর্ষ মিত্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে তার একটি প্রধান প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে মনোনীত করেছে। এ চুক্তির ফলে নয়াদিল্লির সামরিক এবং দ্বৈত ব্যবহারের প্রযুক্তিতে লাইসেন্স-মুক্ত অভিগমনের পথ প্রশস্ত করেছে।

তবে ওয়াশিংটনের জন্য জোট ব্যবস্থার বাইরে কাজ করার সময় গভীর নিরাপত্তা সহযোগিতা সমন্বিত একটি শক্তিশালী কৌশলগত অংশীদারত্ব কোনো স্বাভাবিক বা পরিপক্ব ব্যবস্থা নয়। এ ছাড়া এই ধরনের জোটের শক্তি সম্পর্কে অনেক বাড়িয়ে বলাও হয়ে থাকতে পারে। আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান ন্যাটোভুক্ত দেশ না হয়েও মার্কিন মিত্র বলে বিবেচিত। কিন্তু বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলে। মার্কিন-পাকিস্তান সম্পর্ক মূলত অবিশ্বাস এবং ভিন্ন স্বার্থ দ্বারা পরিপূর্ণ। তারা আসলে কোনো জোটের মতো নয়। আমেরিকার আরও কিছু জোটও নানা কারণে হোঁচট খেয়েছে। এ ছাড়া তুরস্ক, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ্যে নানা ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভ্রান্তিকর পররাষ্ট্র নীতি আমেরিকার অনেক ইউরোপীয় এবং পূর্ব এশিয়ার চুক্তি মিত্রদের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ককে টেনে এনেছে। কিন্তু মার্কিন-ভারত সম্পর্ক নানা রকম বাণিজ্য উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্পের আমলে এক ধরনের স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল।

এটা স্বীকার করতে হবে যে, শুল্ক থেকে শুরু করে ডেটা স্থানীয়করণ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাপারে মার্কিন-ভারত নীতিগত পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্কের শক্তির আরেকটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কারণ কিছু দীর্ঘস্থায়ী ব্যাপার নিয়ে উভয় দেশের যে কঠোর অবস্থান ছিল, তা এখন অনেকটা নমনীয় হতে শুরু করেছে। কিন্তু তাই বলে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনো ছাড় নেই। প্রতিটি দেশ এখনো অন্যের শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে অংশীদারত্ব বজায় রাখে। তবে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর থেকে ইসলামাবাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক অনেকটা নিম্নগামী হয়েছে।

যখন মস্কো নয়াদিল্লির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে রয়ে গেছে, তখন পশ্চিমা সরবরাহকারীদের থেকে অস্ত্র আমদানিতে ভারতের ক্রমবর্ধমান অংশ; রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র সরবরাহ পেতে বিলম্ব; চীন-রাশিয়া অংশীদারত্ব আরও গভীর করার বিষয়ে এর উদ্বেগ এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য এর ক্রমবর্ধমান জনসাধারণের আহ্বান—সবই ইঙ্গিত দেয় যে, রাশিয়া এখন আগের মতো মার্কিন-ভারত উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু নয়।

ইতোমধ্যেই উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে উত্তেজনা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এখানে নতুন কৌশলগত বাণিজ্য সংলাপ মূলত রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ মোকাবিলা করে। আমেরিকান এবং ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের তত্ত্বাবধানে ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড এমার্জিং টেকনোলজিস (ICET) নামক উদ্যোগের লক্ষ্য হলো প্রযুক্তিগত সহযোগিতার জন্য দীর্ঘস্থায়ী আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলো সহজে অতিক্রম করে যাওয়া।

স্বার্থের সমাগম: বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সফরের সময় মূল্যবান কয়েকটি ব্যাপার নিয়ে সঠিকভাবে আলোচনা হওয়া উচিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মোদিকে রাশিয়া এবং ইউক্রেনীয় পক্ষের ওপর চাপ কমানোর জন্য উৎসাহ দিতে পারেন। কিন্তু বাইডেন সেটা করবেন বলে মনে হয় না।

এ ক্ষেত্রে এটা মনে রাখতে হবে যে, মার্কিন-ভারত উভয় পক্ষই ইতোমধ্যে ভারতীয় সামরিক বিমানের জন্য ভারতে জিই ৪১৪ (GE 414) জেট ইঞ্জিন অংশীদারত্বের ভিত্তিতে উৎপাদনের জন্য একটি যুগান্তকারী চুক্তি ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া ভারত ২০২৫ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ নিয়ে যাওয়ার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন আর্টেমিস চুক্তিতেও যোগ দিচ্ছে। এ ছাড়া বড় আমেরিকান কোম্পানিগুলো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, প্রযুক্তিগত পণ্য যেমন সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারতে তারা বড় বিনিয়োগ করবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং অন্যরা ভারতে অধিকার এবং গণতন্ত্রের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ জানাতে পারে বা ইঙ্গিত দিতে পারে। তবে অবশ্যই তা ব্যক্তিগতভাবে, সাবধানে এবং সংক্ষিপ্তভাবে। এমনকি একটি মূল্যবোধভিত্তিক বৈদেশিক নীতি গ্রহণকারী প্রশাসনও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সেই মূল নিয়ম লঙ্ঘন করবে না, যা ট্রাম্পের নৈতিক বিবেচনার স্বার্থ। বিশেষ করে ভারতের প্রেক্ষাপটে যা ওয়াশিংটন দক্ষিণ এশিয়ায় তার সেরা কৌশলগত দিক হিসেবে বিবেচনা করে।

এ রকমভাবে বলা যেতে পারে যে, কেউ যদি একটি কৌশলগত অংশীদারত্বের আশা করে, নরেন্দ্র মোদির সফরের একটি মূল এজেন্ডা হবে চায়নার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারতের প্রচেষ্টা বাড়ানো। এ প্রক্রিয়ায় ভৌগোলিক এবং সাময়িক উভয় ধরনের সহযোগিতার প্রসার ঘটতে পারে। আবার ইন্দো-প্যাসিফিক কোয়াডে মার্কিন ও ভারতীয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এবং মধ্যপ্রাচ্যে আইটুইউটু (I2U2) গ্রুপিংয়ে তাদের ভূমিকার মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। তবে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সহযোগিতাকে জড়িত করার একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া এখানে অনুপস্থিত। একসঙ্গে চীনকে মোকাবিলা করা: এটাও বলা হচ্ছে যে, মোদির সফরের সময় চীনকে মোকাবিলা করার কৌশলের ব্যাপ্তি বাড়ানোর জন্য অংশীদারত্বের সুবিধা নেওয়ার ওপরও জোর দেওয়া হবে। চীনকে ঠেকাতে ভারতের সামরিক সক্ষমতাকে শক্তিশালী করা এই সফরের বড় একটি অংশ। কিন্তু তাই চীনের ওপর বিশ্বের নির্ভরতা কমানোর জন্য সমালোচনামূলক এবং উদীয়মান প্রযুক্তির বৈচিত্র্যময় বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে ভারতকে একীভূত করে গেলে ব্যাপারটি আরও কার্যকরী বলে বিবেচিত হবে।

এ ছাড়া চায়নায় উৎপাদিত পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করার জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন পণ্য যেমন ভ্যাকসিন, ক্লিন এনার্জি প্রযুক্তি, অবকাঠামো স্থাপনের জন্য অর্থায়ন, উৎপাদন এবং সরবরাহ করার জন্য উভয়পক্ষ দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপাক্ষিকভাবে (ইন্দো-প্যাসিফিক কোয়াডের মাধ্যমে) অংশীদারত্বের বিষয়েও আলোচনা করতে পারে।

তবে ওয়াশিংটনের জন্য কোনো একটি জোট ব্যবস্থার বাইরে কাজ করার সময় গভীর নিরাপত্তা সহযোগিতা সমন্বিত একটি শক্তিশালী কৌশলগত অংশীদারত্ব কোনো স্বাভাবিক বা নিয়মিত ব্যবস্থা নয়। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত—উভয়ের জন্য একটি প্রধান পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের গল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাই আশা করা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মার্কিন সফর বিশেষভাবেই উদযাপন করা হবে।

লেখক: ওয়াশিংটন ডিসির উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক। নিবন্ধটি টাইমস অব ইন্ডিয়া থাকে অনুবাদ করেছেন তৌহিদা জান্নাত

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

লিডসের বিরুদ্ধে আর্সেনালের গোল উৎসব

আউটসোর্সিং কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষিত: জোনায়েদ সাকি

এনসিপির কর্মকাণ্ডে ফিরছেন সারোয়ার তুষার

যৌথ বাহিনীর অভিযানে পিস্তলসহ যুবক গ্রেপ্তার 

সাংবাদিকের বাড়িতে চুরি, স্বর্ণালংকারসহ ৫ লাখ টাকার ক্ষতি

৪৫ বছর ভাত না খেয়েও সুস্থ ও সবল বিপ্লব

চেতনানাশক খাইয়ে দুধর্ষ ডাকাতি

রংপুর বিভাগের ৩৩ আসনে খেলাফত মজলিসের প্রার্থী ঘোষণা

প্রার্থিতা প্রত্যাহার নিয়ে ছাত্রদলের নির্দেশনা, না মানলে ব্যবস্থা

নারী শিক্ষার্থীকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে চাকরি খোয়ালেন বেরোবি সমন্বয়ক

১০

হাওর ও চরাঞ্চলের শিক্ষক বদলির তদবির আসে ওপর থেকে : গণশিক্ষা উপদেষ্টা

১১

জয় স্যুটকেস ভরে টাকা নিয়ে গেছে : হাবিব-উন-নবী সোহেল

১২

২৫ বছর ধরে বাঁশির মায়ায় আটকে আছে শফিকুলের জীবন

১৩

একাত্তরেও আ.লীগ পালিয়েছে, এবারও পালিয়ে গেছে : টুকু

১৪

একাদশে ভর্তির দ্বিতীয় ধাপের আবেদন শুরু, শেষ হচ্ছে কবে

১৫

তিন দিনের মধ্যে সাদাপাথর ফেরত না দিলে ব্যবস্থা

১৬

উগান্ডার সঙ্গে ট্রাম্পের চুক্তি, জানা গেল নেপথ্য কারণ

১৭

ইসহাক দারের সঙ্গে কী আলোচনা হলো বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির

১৮

মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু রোববার : রাকসু ট্রেজারার

১৯

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বৈঠক অনুষ্ঠিত

২০
X