মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৩:১৬ এএম
আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০১:৩৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নৈরাজ্য, অগ্নিসংযোগ ও মানবহত্যা মহাপাপ

নৈরাজ্য, অগ্নিসংযোগ ও মানবহত্যা মহাপাপ

পৃথিবীবাসীর জন্য ইসলাম শান্তি ও সাম্যের ধর্ম হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। ইসলাম মানুষের শান্তি ও মুক্তির কথা বলে। প্রতিটি মানুষ ও প্রাণীর জীবনের নিরাপত্তায় ইসলাম দ্ব্যর্থহীন। দ্বন্দ্ব, সংঘাত, নৈরাজ্য, নাশকতা, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, অগ্নিসংযোগ ও মানবহত্যাকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না ইসলাম। সমাজ জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ওপর ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। অশান্তি-বিশৃঙ্খলা তথা ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টিকে কোরআনে হত্যার চেয়েও গুরুতর পাপ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ফেতনা (দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর পাপ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯১)। এ পাপ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এ পাপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন ও গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। কেননা একটি ফেতনা-অশান্তি সমাজে অসংখ্য ফেতনা-অশান্তি ও অরাজকতার জন্ম দিতে পারে। তাই ফেতনা-বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টির বিরুদ্ধে ইসলামের কঠোর অবস্থান।

পৃথিবীতে মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রাথমিক বিষয়ই হচ্ছে তার বেঁচে থাকার অধিকার ও জীবনের সুরক্ষা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংঘাত ও সহিংসতাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। মানবতাবিরোধী সব ধরনের অন্যায় হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাত, অরাজকতা ও অপকর্ম প্রত্যাখ্যান করেছে। সৎকর্মে সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছে এবং জুলুম-নির্যাতনমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দলমত-নির্বিশেষে মানুষের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেতনা এবং অর্থনৈতিক দর্শন ও অপরাধ দমনের কৌশল ইসলামকে দিয়েছে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা। কিন্তু শান্তির ধারক-বাহক জনগণের বিরুদ্ধে সবসময়ই অশান্তিকামী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী দুর্বৃত্তরা সুযোগ খুঁজতে থাকে। সুযোগ পেলেই তারা নিরীহ সাধারণ জনতার ওপর অন্যায় আক্রমণ করে বসে। ইসলাম কখনোই তাদের প্রশ্রয় দেয় না। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, আল্লাহ ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৬৪)

ইসলাম বিশ্বজনীন শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবজাতির জন্য কল্যাণকামী পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ‘ইসলাম’ মানে আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন করা। ইসলামপ্রিয় মুসলমানের পরিচয় দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বুখারি : ৬৪৮৪; মুসলিম : ৪০)। তাই পৃথিবীতে সত্যিকারার্থে সত্য ও ন্যায়নীতির বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বজায় রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে অপরিহার্য কর্তব্য এবং ইমানি দায়িত্ব। সুতরাং মানবসমাজে কোনোরকম নাশকতা, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত, উগ্রতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর এতে বিপর্যয় ঘটাবে না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৫৬)

সমাজজীবনে নাশকতা, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাত দমনে ইসলাম অনুপম দিকনির্দেশনা দিয়েছে এবং সন্ত্রাসী দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধে কঠোর শাস্তি আরোপ করেছে। ইসলামের আলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলিত আইনে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের উপযুক্ত ন্যায়বিচার করা হলে আর কেউ নাশকতা, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে সাহস পাবে না। পবিত্র কোরআনে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকাণ্ডকে মহা অপরাধ সাব্যস্ত করে কঠোর শাস্তির বিধান ঘোষিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কোনো মুমিনকে হত্যা করা কোনো মুমিনের কাজ নয়, তবে ভুলবশত করলে তা স্বতন্ত্র। ...কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে স্থায়ীভাবে থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রাগান্বিত হবেন, তাকে অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৯২-৯৩)

ইসলাম ইচ্ছাকৃতভাবে মানবসন্তানকে হত্যা করা কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ করেছে। নিরপরাধ জনগণকে গুলি করে, বোমা মেরে বা যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগে হত্যা করা, পুড়িয়ে মারা বা প্রাণহানি ঘটানো ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা, তাদের জানমালের ক্ষতিসাধন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করাকে কবিরা গুনাহ আখ্যায়িত করে এবং এর ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কারণ ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকে হত্যা করল; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৩২)।

মানবহত্যা ও মানুষের সব ধরনের ক্ষয়ক্ষতির বিরুদ্ধে ইসলাম। ইসলাম অঙ্গহানি ও আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা তোমাদের প্রতি দয়ালু।’ (সুরা নিসা : ২৯)। হত্যার প্ররোচক কারণ হিসেবে হিংসা-বিদ্বেষ-ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছে ইসলাম। এ বিষয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা একে অন্যের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ কোরো না, হিংসা কোরো না এবং একে অন্যের পেছনে পোড়ো না। আল্লাহর বান্দা সবাই ভাই ভাই হয়ে যাও। কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইকে তিন দিনের বেশি ত্যাগ করা হালাল নয়।’ (বুখারি)। এমনকি হত্যার প্রারম্ভিক বিষয় তথা অস্ত্র দিয়েও কাউকে ভয় দেখাতে নিষেধ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের দিকে অস্ত্র তাক না করে। কারণ সে জানে না, হয়তো শয়তান তার হাত থেকে তা বের করে দিতে পারে, ফলে সে জাহান্নামের গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (বুখারি)। কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মারা বা মারার চেষ্টা জঘন্যতম কাজ। যারা এ কাজ করবে, তারা আল্লাহর রহমত থেকে অবশ্যই বঞ্চিত হবে। আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনের কারণে, তদ্রূপ তারা কেয়ামতের দিন রাসুলের শাফায়াত পাবে না, রাসুলের কথা না মানার কারণে।

অগ্নিসংযোগ ও আগুনে পুড়িয়ে মারার ফলে একসঙ্গে কয়েকটি অপরাধ সংঘটিত হয়, এর কোনো কোনোটি তো শিরকের পর্যায়ভুক্ত। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো মানুষ, জীব-জন্তু বা কোনো ফসল-গাছপালাকে আগুনে পোড়াতে নিষেধ করেছেন। নবী (সা.) আরও বলেন, ‘আগুন দ্বারা শুধু আল্লাহই শাস্তি দেবেন, আগুনের রব (আল্লাহ) ছাড়া আর কারও আগুন দ্বারা শাস্তি দেওয়া উচিত নয়।’ (বুখারি)। রাসুলুল্লাহ (সা.) কাফের-মুশরেকদের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধে কাউকে আগুনে পোড়ানোর অনুমতি দেননি। কারণ জাহান্নামে আল্লাহতায়ালা অপরাধীদের জন্য আগুনের শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। জাহান্নামকে আরবিতে ‘নার’ বা আগুন বলা হয়েছে। তাই এ শাস্তি কোনো মানুষ দিতে চাইলে এতে আল্লাহর বিশেষ শাস্তি প্রয়োগের ক্ষমতায় যেন তার সমাসীন হওয়ার দাবি চলে আসে। তাই কাউকে আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়া নিষেধ।

লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জানাজায় ব্যস্ত খামারি, সেই সুযোগে ৮০০ হাঁস লুট

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে থাকছে না দলীয় প্রতীক, অধ্যাদেশ জারি

‘বিএনপিকে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের নেতারা বিশ্বাস করে’

৩৬ হাজারে বিক্রি ২৪ কেজির কোরাল

কিছু বিষয় আলোচনা না হলেও জুলাই সনদে রাখা হয়েছে : সালাহউদ্দিন

খাবারে বিষক্রিয়া, বন্ধ হলো রণবীরের সিনেমার শুটিং

ভিটাসহ শ্বশুরবাড়ি বিক্রি করে দিলেন নাজমুল

ব্রাজিল দলে জায়গা হারাচ্ছেন ভিনি!

সৌন্দর্যের রহস্য ফাঁস করলেন সানি লিওন

কম্পিউটারের জন্য নিখোঁজ, ১০ দিনেও মেলেনি রাকিবের সন্ধান

১০

বুকে ব্যথা, জ্ঞান হারালেন পাকিস্তানি অভিনেত্রী

১১

ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের মনোনয়নপত্র ক্রয় ঠেকাতে মব করা হয়েছে : রিজভী

১২

আশুলিয়ায় হত্যা মামলার আসামি যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৩

ওয়াইফাইয়ের গতি কম? বাড়াবেন যে ১০ উপায়ে

১৪

জেনেভা ক্যাম্পের হত্যা মামলায় ২৬ আসামিকে গ্রেপ্তার  

১৫

রিয়ালের চুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ভিনি

১৬

মাউশির চেয়ারম্যানসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

১৭

সচিবালয়ের সামনে জুলাই শহীদ পরিবার ও আহতদের অবস্থান

১৮

শিক্ষার্থীদের রাতের আড্ডা বন্ধে চৌদ্দগ্রাম ইউএনওর অভিযান

১৯

কাজে আসছে না কোটি টাকার নৌ অ্যাম্বুলেন্স

২০
X