বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দূর অতীত ও নিকট অতীতের দুটি ঘটনা স্মরণে আনা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আধুনিক উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও ইরান নিয়ে বিশাল সমৃদ্ধ এক সাম্রাজ্য ছিল খোয়ারাজমীয়। ১২১৮ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গল যোদ্ধা ও শাসক চেঙ্গিস খানের রাজ্য থেকে বাণিজ্য করার জন্য একটি দল খোয়ারাজমীয়র ওত্রার প্রদেশে যায়। তখন ওত্রারের গভর্নর ছিলেন ইনালচুক, যিনি গিয়াসউদ্দিন নামেও পরিচিত। গিয়াসউদ্দিন চেঙ্গিস খানের রাজ্য থেকে আসা ওই ব্যবসায়ী দলকে গোয়েন্দা আখ্যা দিয়ে সবাইকে হত্যা করেন। কিন্তু এই দলের একজন কোনোক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে ফিরে যায় চেঙ্গিস খানের দরবারে। চেঙ্গিস খান এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে এই অন্যায়ের প্রতিকার ও বিচার চেয়ে একটি কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল পাঠান খোয়ারাজমীয় সাম্রাজ্যের শাসক দ্বিতীয় শাহ মোহাম্মদের দরবারে। শাহ মোহাম্মদ চেঙ্গিস খানের দাবি অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি সেই প্রতিনিধিদলের প্রধানকে শিরশ্ছেদ করে সেই মাথা চেঙ্গিস খানের কাছে পাঠিয়ে দেন।
ভয়াবহ ক্রুদ্ধ চেঙ্গিস খান খোয়ারাজমীয় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। খান ছিলেন অদ্ভুত এক চরিত্রের শাসক। তার উত্তরসূরিদের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের আগে তিনি ছিলেন তেঙরি বা তেঙারি ধর্মের অনুসারী। তেঙরি শব্দের অর্থ স্বর্গ বা বেহেশত। তিনি তার মা এবং স্ত্রীর কথা মনোযোগ সহকারে শুনতেন। অসাধারণ মেধাবী, দূরদর্শী ও ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার কারণে আজও তিনি ইতিহাসে খ্যাত। ১২১৯ সালে প্রথমে তিনি ওত্রার আক্রমণ করেন এবং আদেশ দেন, সব বাসিন্দা, পশুপাখি এমনকি সরীসৃপ, পোকামাকড় যা সামনে পড়বে সব প্রাণ হত্যা ও ধ্বংস করতে। দুই বছর সময় নিয়ে তিনি বিশাল ওই খোয়ারাজমীয় সাম্রাজ্য নিশ্চিহ্ন করে দেন। শাহ দ্বিতীয় মোহাম্মদকে রুপা গলিয়ে চোখে ও কানে প্রবেশ করিয়ে হত্যা করেন। তিনি অনেকগুলো বিশাল ও পরাক্রমশালী রাজ্য ধ্বংস করেছিলেন তার নিষ্ঠুরতা ও কৌশল দিয়ে। তার একটি কৌশল ছিল তিনি কোনো রাজ্যে প্রবেশ করে ওই রাজ্যের সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন। যখন দুর্গ আক্রমণ করতেন, তখন দুর্গের সৈন্যরা দেখত, তীর বা গোলা ছুড়লেই তাতে মারা যাচ্ছে নিজেদের রাজ্যের মানুষ। মাঝখানে ওই মানুষগুলোকে রেখে পেছন থেকে দুর্গের ওপর গোলা ছুড়ত চেঙ্গিস খানের বাহিনী।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দুটি বার্তা স্পষ্ট। শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে গায়ের জোর খাটাতে নেই, কৌশলে সব কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে এগোতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরেই ওই মোঙ্গলদের মতোই আধুনিক শক্তি, অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে হয়তো অনেক পদক্ষেপ নিচ্ছে, অথবা কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না। সেটা আমাদের জানা নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস শিষ্টাচারে এখন পর্যন্ত একটি উদ্যত কথা সরকার বা কোনো দল সম্পর্কে বলেননি। সুতরাং একজন কূটনীতিকের দায়িত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের আরও সংযত হওয়ার প্রয়োজন আছে। এটা বোঝা যায়, বাংলাদেশের সরকারি দল যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ। কিন্তু তার জবাব হওয়া উচিত কূটনৈতিক ভাষায়, গ্রামের ঝগড়াঝাটির মতো নয়।
দ্বিতীয় বার্তা হলো—বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার প্রধান শিকার হচ্ছে সাধারণ নিরীহ মানুষ—চেঙ্গিস খানের দ্বারা ধৃতরা!
এবার অতীত থেকে মুদ্রার অন্য পিঠের দিকে তাকাই। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশন আমাদের জন্য অতি শিক্ষণীয় বিষয়। ইরানের বিপ্লব এবং দেশটির শতবছরের ঘটনাবলি পশ্চিমাদের প্রয়োজনমাফিক দলবদলের একটি চাক্ষুষ উদাহরণ। ইরানের সঙ্গে শিক্ষা, সংস্কৃতিক আদান-প্রদানসহ নানা ধরনের সম্পর্কে জড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। পাহলভি পরিবারের সঙ্গে এবং ইরানের একের পর এক সরকারের সঙ্গেও ছিল নিবিড় সম্পর্ক। ইরান হয়ে উঠেছিল একটি আধুনিক দেশ। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইরানে চলেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা বিস্তার, উন্নত সংস্কৃতির চর্চা, যা হোয়াইট রেভল্যুশন বলে পরিচিত। কিন্তু ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের সময় যুক্তরাষ্ট্র পিছুটান দেয়। ইরানের ক্ষমতাচ্যুত এবং দেশ থেকে নির্বাসিত শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি মৃত্যুর আগপর্যন্ত বিশ্বাস করতেন, ইরানের তেলের স্বার্থই তাকে উৎখাতের কারণ। তেলের কথাই যখন উঠল, তখন একটু পেছনে না ফিরে পারা যায় না। ১৯০৯ সালে ইরানে প্রবেশ করে ১৯১৩ সাল থেকে তেল রিফাইন করতে শুরু করে। ১৯৫১ সালে ইরানের জাতীয়তাবাদী নেতা মোহাম্মদ মোসাদ্দেক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ইরানের তেল কোম্পানিকে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেন। সঙ্গে সঙ্গে ইরানের আন্তর্জাতিক বাজারে তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় ব্রিটেন। তখন ব্রিটেন আর আমেরিকা ছিল একাত্মা। দুই বছরের মধ্যে মোসাদ্দেককে সিআইএ এবং ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬ মিলে উৎখাত করে ও জেলখানায় পুরে। সেটা ছিল এক করুণ কাহিনি। তখন শাহকে উৎখাত করে তার ছেলেকে সিংহাসনে বসানো হয়। সেই ক্যু ঘটিয়েছিলেন সিআইএর তৎকালীন পরিচালক কেরমিত রুজভেল্ট, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টের নাতি। যাহোক, অন্য কথা না যাই।
পরবর্তীকালে ইরানের শাহের সঙ্গে সব ধরনের সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সে বিপ্লব ঠেকাতে চায়নি। ১৯৭৭ সাল থেকেই তারা জানত। তবে ইরানের বিপ্লবের পেছনে ব্রিটেনেরও বড় হাত ছিল বলে আজ অনেক খবর বেরিয়েছে। যে কোনো দেশে গণআন্দোলন করতে হলে গুজব ছড়িয়ে দিতে হয় এবং নানা ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সংঘটনে মদদ দিতে হয়। ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে ইরানের আবাদান শহরে একটি সিনেমা হলে ‘দি ডিয়ার’ নামক একটি ছবি চলার সময় বাইরে থেকে তালা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মর্মান্তিক সেই ঘটনায় ৪৭০ জন দর্শক পুড়ে মারা যায়। আগুন দিয়েই সারা ইরানে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক এই আগুন দিয়েছে এবং তখনকার ইরানের জনগণ তা বিশ্বাস করে এবং জনমত লাফিয়ে শাহর বিরুদ্ধে চলে যায়। তার দুদিন আগে মাশাদ শহরে আরও একটি নাটক চলাকালে সেখানে আগুন দেওয়া হয় এবং তিনজন নিহত হয়। শিয়া মোল্লাদের বক্তব্য ছিল, দি ডিয়ার ছবিটি ইসলামের জন্য অবমাননাকর এবং পশ্চিমা মূল্যবোধের ছবি, যা ইরানের সমাজের অবক্ষয়ে অবদান রাখছে। কিন্তু মানুষ সেদিকে না তাকিয়ে একচোটে বিশ্বাস করেছে যে, এটি সাভাকের কাজ। ওই ঘটনায় প্রায় প্রকাশ্যে মদদ দিয়েছিল ইরানের কট্টর শিয়া নেতা আয়াতুল্লাহ নুরি হামদানি। কী পরিহাস, পরবর্তী সময়ে নুরি হামদানির মেয়ের জামাইকেই করা হয় তদন্ত কমিটির প্রধান। সাভাকের তৎকালীন পরিচালক নিয়ামতুল্লাহ নাসিরিকে বিপ্লবীরা ১০ ঘণ্টার একটি সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে ফায়ারিং স্কোয়াডে দিয়ে হত্যা করে।
এরকম হত্যার শিকার হয়েছিল ইরানে বিপ্লব সমর্থনকারী বামপন্থিরাও। বিষয়টি মনে রাখা খুব প্রয়োজন, বামপন্থি শত শত ‘চে গুয়েভারা’ ইসলামী বিপ্লবে যোগ দিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে তেহরানে দশ দিনব্যাপী একটি কবিতার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেই উৎসব থেকে সরকারের প্রচণ্ড সমালোচনা করা হয় এবং তা শাহের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিদেশেও তরুণ ছাত্ররা শাহের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। অবশ্যই শাহের শাসনের বহু ত্রুটি ছিল। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বেড়েছিল, রাজতন্ত্রের বিস্তার হয়েছিল, ভিন্নমত সহিষ্ণুতার অভাব ছিল। কিন্তু শাহকে সরাতে গিয়ে আন্দোলনকারীদের আরও চড়া মূল্য দিতে হয়েছে, যা আজও দিয়ে যাচ্ছে। শাহকে পদচ্যুত করার পর ঘটনাক্রমে খোমেনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন এবং হত্যার উৎসব শুরু হয়। স্পেশাল কমিশন গঠন করে মানুষ হত্যা চলতে থাকে। খোমেনির ফতোয়াই ছিল আইন। বামপন্থিদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে দ্রুত বিচারের নামে হত্যা করে বাম রাজনীতিই ইরান থেকে নিঃশেষ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়।
নিজেদের গায়ে গিয়ে না পড়া পর্যন্ত এমন খেলা পশ্চিমারা খেলেছেই। কানে পানি না যাওয়া পর্যন্ত তারা থামেনি। আয়াতুল্লাহ খোমেনি বিপ্লবের আগে ইরাকে এবং শেষদিকে ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কট্টর শিয়া মোল্লারা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ভেঙে প্রবেশ করে। সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের দ্বন্দ্ব। যে ফ্রান্স আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছিল, সেই ফ্রান্সেই ১৯৮৫-৮৬ সালে ১১টি বোমা হামলা হয়, যার পেছনে ছিল ইরান। শুরু হয় ফ্রান্সের সঙ্গে বৈরিতা।
মাঝেমধ্যে ইতিহাসের পাঠ পুনরাবৃত্তি করা ভালো। এতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। কারণ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে একভাবে, না হলে আরেকভাবে। এ নিবন্ধে দুটি ঘটনা বাংলাদেশের মানুষের মনে রাখা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের বোঝা এখন বিশেষ প্রয়োজন যে, ব্যক্তিগত বা সাময়িক ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে আদর্শগত অমিল থাকা কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলানোর অর্থ, নিজের হাত পুড়িয়ে ফেলার সমতুল্য। চরম ডানপন্থি আর চরম বামপন্থি এক কাতারে নামলে যা অর্জন হতে পারে তার ফলাফল শুধুই ইরানের পরিণতি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক