সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:২৯ এএম
আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সরকারের নতুন রূপ, চ্যালেঞ্জ পুরোনোই

সরকারের নতুন রূপ, চ্যালেঞ্জ পুরোনোই

১০ জানুয়ারি চলে গেল। দিনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের বন্দিদশা কাটিয়ে দেশে ফিরে জাতির পিতা যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার একটি অংশ ছিল এমন, মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। কিন্তু আবার এটাও বলেছিলেন, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়।

রোববারের নির্বাচনের পর গতকাল নতুন সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। টানা চতুর্থবারের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আবার ক্ষমতায় বসতে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ। আশা করা যাচ্ছে, সামনের রোববার গঠিত হবে নতুন মন্ত্রিসভা।

এই নির্বাচন হয়েছে বিএনপির বর্জন এবং প্রতিহত করার নামে সহিংসতার মাঝে। হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর নানা ধননের বিরোধিতার মধ্যে। নির্বাচনের আগে ও পরে মার্কিন এবং পশ্চিমা বিশ্বের মতামত বাংলাদেশের পক্ষে সেভাবে উচ্চারিত হচ্ছে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতোই তার কন্যা বারবার সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে তার মতো করে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাবে।

তবে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বা ব্যক্তি যা-ই বলুক না কেন, বড় কাজটা করতে হবে নিজেদেরই। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি অর্জন করলেও নানা কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের আর্থিক অবস্থা যে বিশেষ বদলায়নি তা স্পষ্ট। কম আয়ের মানুষের ওপর মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাবই এখন অর্থনীতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচন ঘিরে দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ভালোভাবেই মোকাবিলা করে সাফল্যের সঙ্গে নির্বাচন করেছে। এখন তার আবার পথচলা। তবে এ চলাটা অর্থনৈতিকভাবে বন্ধুর হতে পারে বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। নতুন সরকারকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, তা হঠাৎ সৃষ্ট কোনো সমস্যা নয়। দীর্ঘদিন ধরে এমনটা চলছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি বাণিজ্যের মন্দাভাব, প্রবাসী আয়ে ধীরগতি, ডলার সংকট এবং এর অতিরিক্ত দাম, রিজার্ভ সংকট, ব্যাংক ‌ও আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা ও উচ্চ খেলাপি ঋণ, সরকারের ব্যয়ের চেয়ে অতি কম আয় এবং বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপসহ সামষ্টিক অর্থনীতির প্রতিটি স্তরই ঝুঁকিতে রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা এবং আমাদের আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতার সঙ্গে বড় আকারে রয়েছে ডলার ও জ্বালানি সংকটের বিষয়গুলো, যার কোনো তাৎক্ষণিক সমাধানের লক্ষণ স্পষ্ট নয়।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির হার কমাতে না পারলে জীবনধারণের ব্যয় কঠিন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জন্য। খাদ্যের বাইরে জীবনের অন্যসব প্রয়োজনের জন্য খরচ করার মতো টাকা মানুষের হাতে থাকছে না। খাদ্যপণ্য, শিক্ষাসামগ্রী, ওষুধের দাম নিয়ে চিন্তিত মানুষ। কোনোমতেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে থাকছে না। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির এক জরিপে উঠে এসেছে যে, ৯৩ শতাংশ খাদ্যের দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন। ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপর পরিচালিত এ জরিপে বলা হয়েছে, মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি ১০ জনের তিনজন পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না, দেশে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের অভিযোগ, তাদের আয় কমেছে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ এবং ধারদেনা করে খাবার কিনে খাচ্ছে নিম্ন আয়ের ৪৫ শতাংশ পরিবার।

বোঝা যাচ্ছে কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতি। মাথাপিছু আয় বাড়লেও সেটা হয়েছে মূলত অতি ধনিক শ্রেণির। নিচের স্তরের মানুষের আয় বাড়ার হার ওপরের স্তরের বা সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের আয় বৃদ্ধির হারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। ফলে এক বাংলাদেশে আসলে দুটি বাংলাদেশ বিরাজ করছে। কারণ সবার আয় সমানভাবে বাড়েনি। উল্টো আর্থিক বৈষম্য বেড়েছে। এ হিসাবে দেখা গেছে, দেশের মাত্র ২১ ব্যক্তির হাতে আছে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। এক শতাংশ ধনকুবেররা এখন দেশের প্রায় ২৫ শতাংশের বেশি সম্পদের মালিক। বৈষম্যের এমন দশা আগে কখনো দেখা যায়নি।

সরকারের সামনে এ অসাম্য কমানোও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেটা কমানো যাবে কি না, আমরা জানি না। কারণ অর্থনীতির মৌলিক জায়গাগুলো সংকটেই আছে। বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থান কমে যাওয়া এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে দুর্ভোগ বেড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের। জ্বালানি সংকট ও দাম, ডলার সংকটে এলসি করতে না পারায় দেশে উৎপাদন সক্ষমতা কমছে। অন্যদিকে বাড়ছে অর্থ পাচার। এগুলো অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয় মোটেই।

বাংলাদেশে কারও কারও জীবনধারা দেখলে, চাকচিক্যময় কিছু স্থাপনা দেখলে, রাস্তায় অতি দামি গাড়ি দেখলে এবং নেতাদের কথা শুনলে মনে হবে বাংলাদেশ ধনী দেশ হয়ে উঠছে। বিষয়টি আসলে তা নয়। বাংলাদেশে একটি শ্রেণির কাছে দ্রুত ধনী হওয়ার এক দেশ। সেটাই বৈষম্য তৈরি করছে। এই বৈষম্য কাঠামোগত। এর বড় কারণ কর জিডিপি অনুপাত খুবই কম। অর্থাৎ ধনীরা ঠিকমতো কর দিচ্ছেন না। ফলে সরকারকে নির্ভর করতে হচ্ছে পরোক্ষ করের ওপর, যা দরিদ্র মানুষের জন্য নিপীড়নমূলক হয়ে উঠেছে।

নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া এমপি নেতাদের হলফনামা দেখলেও দেখা যায় কত দ্রুত এদের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ এ হলফনামাও পুরোপুরি সত্য নয়। অনেক কিছু লুকানো হয়েছে। ধনীদের আয় যেভাবে বেড়েছে, বিনিয়োগের প্রবণতা ততখানি বাড়েনি, তারা ততখানি করও দিচ্ছেন না। মূল্য সংযোজন করের বোঝা দরিদ্রদের ওপরই বেশি। কথাটি শুধু ভ্যাট নয়, যে কোনো পরোক্ষ করের ক্ষেত্রেই এই একই ঘটনা ঘটে। পরোক্ষ কর চরিত্রে নিপীড়ক, অর্থাৎ কার আয় কম বা বেশি, এই করের হার তার ওপরে নির্ভর করে না। অতি ধনী থেকে একেবারে নিঃস্ব প্রত্যেকেই সমান হারে পরোক্ষ কর দিতে বাধ্য। যারা ধনী, তাদের থেকে বেশি হারে প্রত্যক্ষ কর আদায় করা যায়, কিন্তু এখানেই বর্তমান ব্যবস্থার বড় কাঠামোগত সমস্যা। সেটা করতে পারছে না বা করা হচ্ছে না কারণ মন্ত্রী, এমপি হয়ে তারাই নীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।

একটি দেশের অর্থনীতিকে তখনই সার্বিকভাবে ভালো বলা যেতে পারে, যখন তা সর্বস্তরের জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়। সেটা অনেক দিন ধরেই দেখছি না আমরা। একটি বড় চিন্তার জায়গা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও অপশাসন। দুর্নীতি আর্থিক খাতের সুশাসনকে ব্যাহত করছে। এক ব্যক্তির হাতে অনেকগুলো ব্যাংক, প্রাইভেট ব্যাংকগুলোতে মালিকদের দৌরাত্ম্য, সরকারি ব্যাংকে রাজনৈতিক প্রভাব বড় বড় কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে। দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা যে দরকার সেটা অতি সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছে। সংকটের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে ব্যাংকিং কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য, সরকারি এবং বেসরকারি দায়িত্বকে পুনর্জীবিত করা প্রয়োজন।

জনগণের টাকা নিয়ে কার্যপরিচালনা করার কথা ব্যাংকগুলোর। অথচ মালিকদের অনেক অনৈতিক, অপরাধমূলক ও দুর্নীতি প্রবণতার আশ্রয় হয়ে উঠছে এ ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত কিংবা ব্যক্তিগত সব ব্যাংকেই সংঘটিত অনেক বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় চিড় ধরিয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। সরকার সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে, ব্যাংক খাতে দুর্নীতির লাগাম টানতে না পারলে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারলে, সামগ্রিক অর্থনীতিই চাপের মধ্যে থাকবে। শুধু আর্থিক খাত নয়, সামগ্রিকভাবে দুর্নীতি ও টাকা পাচার রোধে সরকারের ভাবনাটা স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। সবকিছু অস্বীকার করার প্রবণতায় বা কথায় জিতে যাওয়ার আনন্দে রাষ্ট্রীয় সুশাসন আসে না।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হেরোইনসহ মাদককারবারি আটক

কনডেম সেলে বন্দি রাখা অবৈধ ঘোষণায় হাইকোর্টকে আসক-এর সাধুবাদ 

বিদেশে বসে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়া হয় : দীপু মনি

২৫ বছর অপেক্ষার পর বিএনপি থেকে জাপায় এসেছি : রুনা খান

মৃত বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়ে অজ্ঞান, হাসপাতালে ৭

নিয়োগ দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, থাকছে না বয়সসীমা

জালালাবাদ গ্যাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মুখ খুললেন ব্যারিস্টার সুমন

গোসল করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন যুবক

রাতে ঢাকাসহ ৮ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

বিএনপির পর্তুগাল শাখার নতুন কমিটির অভিষেক ও পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত

১০

‘ক্ষমতা সবার হাতে নিরাপদ নয়’

১১

রূপায়ণ সিটি ও ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের চুক্তি স্বাক্ষর

১২

ভোটের পরিবেশ নষ্ট করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা : রাজশাহীর ডিসি

১৩

ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের ২ ইউনিটের ফল প্রকাশ

১৪

অনুমোদনহীন ৫ ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস, মালিকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

১৫

কাবিখা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে চেয়ারম্যানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

১৬

মৃত কন্যার বিয়ের জন্য মৃত পাত্র খুঁজছেন বাবা-মা

১৭

সর্বজনীন পেনশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রত্যাহারের দাবি বেরোবি শিক্ষক সমিতির

১৮

নিজের উদ্ভাবিত চিকিৎসায় ক্যানসার থেকে বেঁচে ফিরলেন চিকিৎসক

১৯

আজ অনলাইনে রোমান্স করার দিন

২০
X