সুভাষ সিংহ রায়
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:২২ এএম
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যা দেখি যা শুনি

আওয়ামী লীগের দলাদলি

আওয়ামী লীগের দলাদলি

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমরা দল গড়িয়া তুলিতে পারি না; কিন্তু দলাদলি করতে পারি।’ ৭৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা দলের ভেতরে দলাদলি। অনেকে বলে থাকেন, ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ হারাতে পারে না এবং এ কথার যথার্থতা রয়েছে। বাংলাদেশের আপামর জনগণ ২০২৪ সালে যে আওয়ামী লীগকে দেখছে, তা কি তারা দেখতে চেয়েছিল? নির্বাচনের আগে ও পরে ২৯৯ সংসদীয় আসনের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভেতরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংঘাতের যেসব সংবাদ গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা রীতিমতো শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হয় যেন গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের কালো মাকড়সা দিন দিন বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি ইউনিটে সভাপতি গ্রুপ ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ নামে বিভাজন রেখা স্পষ্ট হয়ে গেছে। এমপি গ্রুপ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গ্রুপ, উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রুপ নানাভাবে বিভক্তি রেখা স্পষ্ট হয়ে আছে এবং যেটা নির্বাচনের আগে বিশেষ করে তপশিল ঘোষণার পর থেকে তা উৎকট আকারে দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের আগে ও পরে নির্বাচনকেন্দ্রিক বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য শুনলে বোঝা যায়, সম্পর্কের অবনতি কতটা মারাত্মক পর্যায়ে গেছে।

মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। বাংলা একাডেমির কর্মকর্তারা তাদের অনুরোধ করেছিলেন সাধারণ সম্পাদকের জন্য আমন্ত্রণপত্রটি নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয়, আওয়ামী লীগের সেই কর্মীরা জানালেন, সাধারণ সম্পাদকের আমন্ত্রণপত্র নেওয়ার জন্য অন্য কর্মীরা আসবেন। তাহলে বোঝা যায় বিভাজন রেখা কতটা স্পষ্ট। দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য অঙ্গসহযোগী প্রতিষ্ঠানের কাউন্সিল হয় না। আবার বেশ কয়েক বছর পর কাউন্সিল হলেও কমিটি হয় না। এমনও উদাহরণ আছে, কাউন্সিলের এক বছর পর কমিটি হয়, তাও আবার পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় না। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ঘোষিত হয় এক বছর পর এবং মাসের পর মাস এভাবেই চলতে থাকে। দেশের অনেক জেলায় আওয়ামী লীগের ভেতরে গ্রুপিং আজ সর্বজনবিদিত। অবাক করার বিষয়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছেন। গত নির্বাচনে, অর্থাৎ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে আওয়ামী লীগের ভেতরে একে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যক্তিবিদ্বেষ ছড়িয়েছেন, সেটা কি আওয়ামী লীগের নেতারা বিবেচনায় নিয়েছেন? আমার তো মনে হয়, এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নেতাদের কোনো রকম ভাবনা-চিন্তা আছে বলে মনে হয় না।

দুই. ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলায় একটা অসাধারণ বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম ‘শেখ মুজিবের বাংলাদেশ প্রত্যক্ষদর্শীর ডায়েরি থেকে ১৯৭২-১৯৭৬’। বইটির লেখক মিহির মৈত্র। লেখক স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চার বছরে ভারতীয় হাইকমিশনে একজন কূটনৈতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আজকের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জন্য বইটি পাঠ্য হওয়া উচিত। লেখার এ পরিসরে সেই প্রকাশিত বইয়ের কয়েকটা লাইন চয়ন করতে চাই। শুধু এটুকু বোঝাতে চাই, বঙ্গবন্ধু কার সন্তান ছিলেন, সব সময় বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান তার ছেলেকে নীতিনৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে পড়েছি, শেখ লুৎফর রহমানের সেই অসাধারণ উক্তি ‘বাবা, রাজনীতি করো আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ, এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, ‘Sincerity of purpose and honesty of purpose’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।’ এটি বঙ্গবন্ধু সব সময় মনে রাখতেন।

এবার আরেকটি অজানা কাহিনি মিহির মৈত্রের লেখা থেকে জানব। ‘বাংলাদেশ নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে ভারতীয় দূতাবাসের হাইকমিশনার ছিলেন বাংলাদেশের ভূমিপুত্র, চট্টগ্রামের রত্নগর্ভা মায়ের সুসন্তান সুবিমল দত্ত। কলকাতা, কেয়াতলার এই বাসিন্দা ছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ডান হাত, পোড়খাওয়া ব্রিটিশ যুগের আইসিএস। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী প্রথম পরিচয় থেকেই সুবিমল দত্তকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এবং দুজনের ভেতর ছিল এক স্নেহের সম্পর্ক। ফরেন সেক্রেটারি, ইন্ডিয়ান রিপ্রেজেন্টেটিভ টু ইউএন এবং ভারতীয় দূত হিসেবে শ্রীলঙ্কা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ইত্যাদি দেশে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে দিল্লির সাউথ ব্লকে প্রধানমন্ত্রীর অলিন্দে সুবিমল দত্তের নামটি ইফিসিয়েন্সি এবং সাকসেসের পরিভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হতো।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শ্রীমতি গান্ধী তাকে ছাড়া আর কারও নাম মনে করতে পারেননি। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দূত হিসেবে কাজ করতে যাওয়ার অর্থ একটা বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হওয়া। খুব বিচক্ষণ এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছাড়া নানা বাদ-বিবাদ, দুঃখ-দারিদ্র্য, অভাব-অনটনে দীর্ণ দেশে কাজ করা অসম্ভব। সুবিমল দত্তই সেই সুযোগ্য ব্যক্তি, যিনি প্রথম ভারতীয় হাইকমিশনার হওয়ার উপযুক্ত, যাকে জওহরলাল নেহরু একদম কাছছাড়া করতেন না। সাউথ ব্লকে একটা কথা তখন চালু ছিল যে, মায়ের মৃত্যুতেও সুবিমল বাবু ছুটি পাননি। শ্রাদ্ধক্রিয়ার জন্য মাত্র দেড় দিন ছুটি পেয়েছিলেন। এসেছিলেন কলকাতায়। তাও দুবেলা প্লেন-লোড ফাইল আসত দিল্লি থেকে; সুবিমল বাবুর কমেন্ট, অ্যাপ্রুভাল এবং সিগনেচার নিয়ে আবার ফাইলগুলো উড়ে যেত দিল্লিতে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও অনেক আগে থেকে চট্টগ্রামের এই কৃতী সন্তানের নাম জানতেন এবং তার সম্বন্ধে অনেক ভালো কথা শুনেছেন। তাই বর্ষীয়ান ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে তাকে পেয়ে স্বভাবতই বঙ্গবন্ধু খুশি হয়েছিলেন এবং ঢাকায় বাংলাদেশের নানা সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে সুবিমল দত্তের সঙ্গে আলোচনা করে সঠিক উন্নতির পথে দেশকে নিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আর সুবিমল দত্তের সম্পর্ক নিয়ে ঢাকায় একটি গল্প প্রচলিত ছিল। লোকমুখে শোনা। অনেকদিন আগের কথা। তখন ব্রিটিশ যুগ। নবীন আইসিএস এসেছেন ফরিদপুরে এসডিও হয়ে। তাকে প্রথম অভ্যর্থনা জানান বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং যতদিন সুবিমল দত্ত ফরিদপুর ছিলেন তার অভাব-অভিযোগ, সুবিধা-অসুবিধা সবকিছু দেখতেন তিনি। এরপর বহু বছর কেটে গেছে। ব্রিটিশ সরকার দেশকে দুই ভাগ করে দিয়ে চলে গেছে। ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ উত্তাল হয়েছে তারই পুত্রের নেতৃত্বে। অবশেষে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মুখ থেকে তার পিতা শুনলেন সুবিমল দত্তের নাম। তখনই তিনি দেখা করতে চাইলেন তার পুরোনো অফিসারের সঙ্গে। বাবার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করলেন শেখ সাহেব। বাবাকে ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকা আনলেন। একদিন সকালে ভারতীয় হাইকমিশনার বঙ্গবন্ধুর ডাকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে গিয়ে হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত। ড্রইংরুমে শেখ মুজিবুর রহমান সুবিমল দত্তের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলেন তার বাবার। বহু প্রতীক্ষিত মিলনের আনন্দের আতিশয্যে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না মুজিবুরের পিতা। বৃদ্ধের দুচোখে আনন্দাশ্রু। বললেন, ‘আমারে চিনছেন স্যার? হেই যে আপনারে ফুলের তোড়া দিয়া শ্যাষবার সেলাম করছিলাম।’

সুবিমল বাবু এগিয়ে এসে বৃদ্ধের হাত দুটি ধরে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর নানা জায়গায় গেছি কাজের সম্পর্ক নিয়ে, কিন্তু কোথাও আপনার মতো মানুষ দেখিনি। আপনার ভালোবাসার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না।’

বৃদ্ধ তখন উত্তেজনায় কাঁপছেন। পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খাড়াইয়া খাড়াইয়া দ্যাখস কী? কদমবুচি কর, কদমবুচি কর, এই মানুষ কত বড় অফিসার জানস? তর চাইয়া অনেক বড়।’ প্রধানমন্ত্রীর পিতা প্রটোকল জানেন না, কূটনীতি জানেন না, দুই দেশের বিভাজন জানেন না, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক ব্যবহারিক নীতি জানেন না, ভৌগোলিক সীমারেখা জানেন না—শুধু জানেন প্রাণের মানুষটি, শ্রদ্ধার মানুষটি, ভালোবাসার মানুষটিকে। শেষ বয়সে সেই মানুষটি আবার এসেছেন ফিরে বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার হয়ে, যখন তার পুত্র প্রধানমন্ত্রী। কত কী পাল্টে গেছে। কূটনীতির নিয়ম অনুসারে তার পুত্রের সম্মানিত স্থান এখন সুবিমল দত্তের অনেক ওপরে—সে কথা বৃদ্ধ মানতে চান না। ওদিকে ভারতের হাইকমিশনার বারবার বোঝাতে চাইছেন বৃদ্ধকে, তার পুত্র এখন অনেক সম্মানিত এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বৃদ্ধের চোখে তখনো ব্রিটিশ যুগের এক এসডিও তার পুত্রের চেয়ে শতগুণে বড়।’

বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখার গৌরচন্দ্রিকায় যে বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছি দ্বিতীয় অংশের একটা বিশেষ সম্পর্ক করেছে। বলতে চেয়েছি, আওয়ামী লীগের নেতারা দেশব্যাপী যদি শিক্ষা প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করেন এবং প্রতিনিয়ত চর্চার মধ্যে রাখেন, তাহলে দলের গুণগত পরিবর্তন হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মাদ্রাসাপ্রধানদের জন্য অধিদপ্তরের জরুরি নির্দেশনা, না মানলে ব্যবস্থা

বরাদ্দ পেল বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর দাবি ব্যবসায়ীদের

একদিনের সফরে কক্সবাজার যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

যে বয়সের আগেই শিশুকে ৮ শিক্ষা দেওয়া জরুরি

দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ‘চাঁদাবাজ’ আখ্যা প্রধান শিক্ষকের, তদন্তে কমিটি

চট্টগ্রাম-৩ আসনে ধানের শীষের মনোনয়নপ্রত্যাশী মিল্টন ভুঁইয়া

বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা নিয়ে ‘সুখবর’ পাচ্ছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা

ফেসবুক পেজ জনপ্রিয় করার ৮ কৌশল

বাড়ির আঙিনায় বিষধর পদ্মগোখরা, অতঃপর...

১০

মোবাইল দিয়েই ডিএসএলআর ক্যামেরার মতো ছবি তোলার ৫ কৌশল

১১

বরইতলা নদীর ‘বাঁধ’ এখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর

১২

ইস্পাত খাতে বিশেষ তহবিল চান ব্যবসায়ীরা

১৩

বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে আগ্রহী পাকিস্তান

১৪

উপকূলজুড়ে টানা বৃষ্টিপাত, জনজীবনে দুর্ভোগ

১৫

উমামা-সাদীর নেতৃত্বে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল ঘোষণা

১৬

ডেঙ্গুতে আরও ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩১১ জন

১৭

ডাকসু নির্বাচন / ঢাবি শিক্ষার্থীদের প্রতি মির্যা গালিবের আহ্বান

১৮

বাংলাদেশি সন্দেহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মারধর

১৯

মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করে কান্না করলে কি কবরে আজাব হয়?

২০
X