ফয়েজ আহ্মদ কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক। তিনি ১৯২৩ সালের ২ মে বিক্রমপুরের বাসাইল ভোগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত মুক্ত চিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল লেখকদের সংগঠন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের প্রথম সম্পাদক। এ সংগঠনের সভাপতি ছিলেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন। ফয়েজ আহ্মদ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন প্রায় ১৩ বছর। ১৯৪৮ সাল থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ ও পরবর্তী সময়ে পূর্বদেশ পত্রিকার চিফ রিপোর্টার ছিলেন। সাপ্তাহিক ইনসাফ ও ইনসান পত্রিকায় রিপোর্টিং করেছেন। ১৯৫০ সালে হুল্লোড় পত্রিকা ও ১৯৭১ সালে স্বরাজ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি জাতীয় সংবাদ সংস্থার (বিএসএস) প্রথম প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরে দৈনিক বঙ্গবার্তার প্রধান সম্পাদক রূপে কাজ করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় ঢাকার অফিসের প্রধান সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর সিন্ডিকেটের সদস্য নির্বাচিত হন আশি ও নব্বইয়ের দশকে। তিনি আশির দশকে জাতীয় কবিতা উৎসবের প্রথম পাঁচ বছর আহ্বায়ক ছিলেন। তা ছাড়া ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমির কাউন্সিল সদস্য (গোপন ব্যালটে) নির্বাচিত হন। কিন্তু সামরিক শাসনের প্রতিবাদে অন্য ছয়জনের সঙ্গে পদত্যাগ করেন।
ফয়েজ আহমদ সারা জীবন প্রধানত শিশু-কিশোরদের জন্য ছড়া ও কবিতা লিখেছেন। তার বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১০০। এর মধ্যে ৫০টি শিশু-কিশোরদের জন্য ছড়া ও কবিতার পুস্তক। সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে বিশেষ অবদানের জন্য বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পুরস্কারগুলোর মধ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিশু একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক অন্যতম। ফয়েজ আহমদ বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বরে বিনা পাসপোর্টে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্টদের ছত্রছায়ায় ভিয়েনায় আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে যোগ দেন। সম্মেলনে সেজন্য তাকে ‘হিরো’ বলা হতো। তিনি ১৯৫৭ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় লেখক সম্মেলন, ১৯৯৫ সালে মার্কিনবিরোধী কিউবার হাভানায় অনুষ্ঠিত সম্মেলন এবং একই বিষয়ের ওপর ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৮৬ সালে চীন ও উত্তর কোরিয়ার আমন্ত্রণে লেখক ইউনিয়নের পক্ষে বিখ্যাত লেখকদের একটি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে দুটি দেশে মাসব্যাপী সফর করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি উত্তর আমেরিকায় বাঙালিদের ‘ফোবানা’ মহাসম্মেলনে নিউইয়র্কে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় গ্রেপ্তার হন। চার বছর কারান্তরালে থাকার পর ১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে মুক্তি পান। চার বছর কারাভোগের পর তাকে এক বছরের জন্য ঢাকায় রমনা থানা এলাকায় নজরবন্দি করে রাখা হয়। এরশাদের আমলেও তিনি গ্রেপ্তার হন। দেশের রাজনীতিতে এরশাদের পতন একসময় আবশ্যক হয়ে ওঠে। সে সময় সবাই দুই নেত্রীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কামনা করেন। ফয়েজ আহমদ তখন দুই নেত্রীকে এক রাতে গোপনে ঐক্যবদ্ধ করেন। এ ছিল ঐতিহাসিক ঐক্য। তিনি ছিলেন ১৯৯১ সালে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে গঠিত ‘গণআদালত’-এর ১১ জন বিচারকের একজন। ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ফয়েজ আহমদ মারা যান।