শিক্ষকের নীতি-নৈতিকতা-আদর্শের এমন অধঃপতন হলে ভরসা-আস্থা-বিশ্বাসযোগ্যতা আর দায়িত্ববোধের জায়গা বলে সমাজে আর কিছু থাকে কি? একের পর এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির অভিযোগের ঘটনা নিঃসন্দেহে চূড়ান্ত পর্যায়ের সামাজিক অবক্ষয়েরই ইঙ্গিত বহন করে। এই পরিস্থিতি যে কোনো সমাজের জন্য ভয়াবহ, তা বলাই বাহুল্য।
দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলে আবারও এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে বহু ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। শনিবার কালবেলায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তিনি প্রায় এক দশক ধরে শিশুছাত্রীদের নানাভাবে যৌন নির্যাতন করে আসছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির আজিমপুর শাখার গণিতের শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকার। শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির ঘটনায় কয়েকজন অভিভাবক গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটিতে লিখিত অভিযোগ করেন। এর ভিত্তিতে এক দিন পর একটি প্রাথমিক তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী। তবে কমিটি গঠনের পরপরই অভিযোগ ওঠে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার নানা চেষ্টার ব্যাপারে। ভুক্তভোগীদের ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল’ করা এবং ডেকে এনে হুমকি-ধমকি দিয়ে মুখ বন্ধ রাখার অভিযোগ ওঠে অভিযুক্ত শিক্ষক এবং খোদ তদন্ত কমিটির সদস্য ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় গভর্নিংবডির সদস্য মৌসুমী খানকে, সদস্য হিসেবে রয়েছেন ড. ফারহানা খানম, চাঁদ সুলতানা ও রুবীনা তাসমীন। কমিটিতে শাখাপ্রধানদেরও সদস্য করা হয়। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, সেই কমিটির খোদ আহ্বায়ক মৌসুমী খান জানেনই না যে তাকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে! একাধিক সদস্যেরও একই অবস্থা। তারা সবাই পরবর্তী সময়ে জানতে পেরেছেন অন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে, আনুষ্ঠানিকভাবে নয়। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত পর্যায়ের উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। অতিসম্প্রতি দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে উঠেছে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ, যা খুবই হতাশার। আমরা জানি, ভিকারুননিসার মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে এমন অভিযোগ রয়েছে এর আগেও একাধিকবার। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসেও এই স্কুলের শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। তবে প্রতিষ্ঠানটি যৌন নিপীড়নের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার জন্ম দেয় এক দশকেরও বেশি সময় আগে। ২০১১ সালে স্কুলটির শিক্ষক পরিমল জয়ধরের দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের কথা সবারই জানা। সেই ঘটনায় ২০১৫ সালে ধর্ষক পরিমলকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। এতসব ঘটনার পরও একই প্রতিষ্ঠানে বারবার এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আমরা মনে করি, শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থী নিরাপদ নয়—এর চেয়ে হতাশার চিত্র নেই! সামাজিক, নৈতিক ও আদর্শিক অবক্ষয়ের এই স্রোত রুখতে পারে যে অভিভাবক, সেই যদি অবক্ষয়ের তলানিতে পৌঁছে, তাহলে ভরসাটা কোথায়? একজন শিক্ষকের জন্য শিক্ষক সমাজ আজ নিশ্চয়ই লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছে। আমরা সেইসব প্রকৃত শিক্ষাগুরুর জন্য অত্যন্ত দুঃখি বোধ করছি। তবে এসব ঘটনা এটাই প্রমাণ করে, সার্বিকভাবেই নারীর প্রতি আমাদের মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কতটা জরুরি। আমরা চাই, এই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির দায়সারাভাব ও তদন্ত কমিটির সদস্যদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার পাশাপাশি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং প্রমাণ সাপেক্ষে দোষীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হবে। যৌন হয়রানি বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবিক প্রয়োগ হোক—চাওয়া এটাই।