পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে প্রবাসী বাংলাদেশি, বিশেষ করে শ্রমিকদের বড় একটি অংশ অবৈধভাবে প্রবেশ করে। তাদের কেউ কেউ সেখানকার আইন প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। আবার অনেকেই ধরা পড়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমানো এসব বাংলাদেশির জীবনে স্বভাবতই তখন নেমে আসে অনিশ্চয়তা এবং নিয়ম অনুযায়ী শাস্তি ভোগ করতে হয় তাদের। তবে আইন অনুযায়ী সাজা খাটার পর তাদের দেশে ফেরতের যে প্রক্রিয়া, তা করে থাকে সেখানে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস। তখন ভুক্তভোগীর জীবনের অনিশ্চয়তা এবং তার স্বজনের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার নিরসন বা এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষাকর্তা বলতে একমাত্র দূতাবাসই ভরসা। সেই দূতাবাসই যদি হয় ব্ল্যাকমেইলার, তাহলে ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনদের সংকটটা কোন পর্যায়ে পৌঁছায়, তা উপলব্ধি করা কঠিন নয়। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাসের দুই কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততায় এমনই এক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেট বাংলাদেশের একটি ট্রাভেলস কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশিদের জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
রোববার কালবেলায় প্রকাশিত ‘মালয়েশিয়ার জেলের চাবি এনজেড ট্রাভেলসের হাতে’ শীর্ষক প্রধান শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটক আছেন ১৫৯ বাংলাদেশি। সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ট্রাভেল পাসের জন্য তাদের মুক্তি মিলছে না। এ ছাড়া আটক হয়ে জেল খাটছেন ৫৮৪ জন। নিয়ম অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় কোনো বিদেশি আটক হলে তাকে প্রথমে থানায় রাখা হয়। এরপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাওয়া হয়। কাগজপত্র নিয়ে পরিচিতজন বা যে কোম্পানিতে তিনি কাজ করেন, সেই কোম্পানির মালিক থানায় যোগাযোগ করেন। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ছেড়ে দেওয়া হয়। কেউ যোগাযোগ না করলে বা কাগজপত্র না থাকলে সর্বোচ্চ ১৪ দিন পর্যন্ত থানায় আটক রাখার বিধান রয়েছে। এই ১৪ দিনের মধ্যে কেউ যোগাযোগ না করলে দেওয়া হয় মামলা। মামলায় অপরাধভেদে ২ মাস থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সাজার বিধান রয়েছে। সেইসঙ্গে জেলখানা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস বরাবর আটক ব্যক্তির তথ্য প্রেরণ করে। দূতাবাস সেসব তথ্য নিয়ে দেশে ওই ব্যক্তির ঠিকানা বা সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠায়। আটক ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করে থানা থেকে দূতাবাসে মেইল পাঠানো হয়। পরিচয় শনাক্তের পর তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দূতাবাস থেকে ইস্যু করা হয় ট্রাভেল পাস ও বিমানের টিকিট। টিকিটের টাকা ভুক্তভোগীর পরিবার বহন করে। আর সাজা খাটার মেয়াদ শেষ হলে আটক ব্যক্তি দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে ফিরে আসেন দেশে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, নিয়ম এমনটা হলেও বাস্তবে ঘটছে তার উল্টো। এ সিন্ডিকেটের দাবি মেটাতে পারলেই মিলছে বন্দিশিবির থেকে মুক্তি এবং দূতাবাসের ট্রাভেল কার্ড। আর না পারলে বন্দিশিবিরে তাদের ওপর নেমে আসছে নানা নির্যাতন। আমরা মনে করি, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাস ঘিরে গড়ে ওঠা এ সিন্ডিকেট শুধু ভুক্তভোগীদের ভোগান্তিই বাড়াচ্ছে না, তারা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট করছে। ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ নামেখ্যাত প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে কী পরিমাণ অবদান রাখছেন, তা কারও অজানা নয়। তাদের সঙ্গে সংঘটিত এ অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত দূতাবাস কর্মকর্তা এবং উল্লিখিত ট্রাভেল এজেন্সির কেউ যেন ছাড় না পায়, এ বিষয়ে দ্রুত সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ নিতে হবে। তদন্তের মাধ্যমে এই অনৈতিক কাজে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে—এটাই চাওয়া।