রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪, ০২:২৮ এএম
আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৪, ০৮:৩২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সিংহাসনের অসহায়ত্ব

সিংহাসনের অসহায়ত্ব

বাংলায় একটা বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘চুন খেয়ে গাল পুড়েছে, দই দেখলে ভয় করে।’ কোন বিদেশি কী মতলবে আসেন, কেন আসছেন—তাতে কতটা দেশের ভালো হবে, কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নিয়ে বাঙালি তথা উপমহাদেশের মানুষ বরাবরই সন্দিহান ছিল। সবাই যে দুরভিসন্ধি নিয়ে আসেন, তা মোটেই নয়। কিন্তু সাবে উপনিবেশ দেশগুলোর অভিজ্ঞতা যে ভালো না! কোনটা যে দই আর কোনটা যে চুন—তা বোঝার বিশেষ কোনো যন্ত্র নাই। ইতিহাসের দিকে তাকানো ভালো। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা প্রাত্যহিক জীবনে কাজে আসে। ইতিহাস পাঠ ছাড়া মানুষ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

ভারতবর্ষের আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেছিল ইন্দোনেশিয়ায়। কিন্তু ডাচ ও পর্তুগিজদের জন্য খুব একটা জুত করতে পারেনি। তাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, স্পেনিশ ও পর্তুগিজদের সঙ্গে। পর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর তারা ভারতের সুরাট বন্দরের দিকে নজর দিয়েছিল। কোম্পানি সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে উইলিয়াম হকিন্সকে পাঠিয়েছিল একটুখানি বাণিজ্য করার অনুমোদনের আশায়। হকিন্স তার সঙ্গে উপঢৌকন, খেলনা ও রুপার চেইনসহ ঘড়ি উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন সম্রাটের জন্য। কিন্তু তাতে খুব মন গলাতে পারেননি সম্রাটের। কারণ হকিন্স ভারতের রাজদরবারের ক্ষমতার পেছনের বিনি সুতোয় বাঁধা ক্ষমতার গোড়ায় পৌঁছাতে পারেননি। এরপর কোম্পানি ব্রিটিশ রাজা প্রথম জেমসের কাছে আবেদন করে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে যেন একজন দক্ষ রাজদূত পাঠানো হয়। সম্রাটের রাজ দরবারের আচার-আচরণ সম্পর্কে জানে, দরবারের ব্যবহার আচারে পারদর্শী এমন একজনকে খুঁজতে থাকলেন তারা। অবশেষে ব্রিটিশ রাজার পক্ষ থেকে বাছাই করা হলো তুখোড় কূটনীতিক, মেধাবী ও চতুর থমাস রোকে। প্রথমে থমাসের অনুমতি নিতে হয় সুরাতের গভর্নর জুলফিকার খানের কাছ থেকে। বহু দেনদরবার করেই ১৬১৬ সালে জাহাঙ্গীরের দেখা পান থমাস রো। জাহাঙ্গীর ছিলেন রোমান্টিক মানুষ। তিনি রাজ্য শাসনের চেয়ে মদ পান ও নারী সঙ্গই বেশি পছন্দ করতেন। এসব তথ্য থমাস আগে থেকেই জেনে এসেছেন। তিনি সম্রাটের জন্য একরকম জাহাজ ভরে রেড ওয়াইন এবং বিয়ার নিয়ে এলেন। সম্রাট বেশ খুশি। এমন জিনিস তো আগে চেখে দেখা হয়নি! থমাস রো সম্রাটের কাছে গল্পে গল্পে জানালেন বিয়ার কী করে তৈরি করা হয়। অতঃপর থমাস হয়ে উঠলেন সম্রাটের গ্লাস ফ্রেন্ড। প্রথমে থমাস মনে করলেন তিনি সাকসেস! কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন থমাস অচিরেই দেখলেন, সম্রাট সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বটে, সেটা অফিসিয়ালি। প্রকৃতপক্ষে পাকঘর থেকে প্রশাসন সবকিছুর মূল চাবিকাঠি সম্রাজ্ঞী নুরজাহান এবং তার আত্মীয়স্বজনের হাতে। নুরজাহানের পিতা ইতিমাদুদ্দৌলা এবং ভাই আসাফ খান ছিলেন প্রসাদের মূল ক্রীড়নক। এই আসাফ খানেরই মেয়ে আরজুমান্দ বানু বেগম ওরফে মমতাজ বেগমকে জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র খুররম বা শাহজাহানের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। জাহাঙ্গীরের জ্যেষ্ঠ পুত্র খুসরো ছিলেন বিতাড়িত, যাকে পরবর্তী সময়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। একই ভাবে শাহজাহানও পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সাম্রাজ্যের অধিকর্তা হন। কারণ পরিষ্কার। প্রাসাদের অভ্যন্তরের ক্ষমতা ছিল নুরজাহান, তার পিতা, ভাই এবং অনুগত ‘আমলা’দের হাতে।

তখন ভারতবর্ষে বাণিজ্যিক ঘাঁটি করা নিয়ে পর্তুগিজ, ডাচ, ফ্রেঞ্চ, স্পেনিশ এবং ইংলিশদের মধ্যে চলেছে কাড়াকাড়ি। অবশেষে ইংলিশরাই ধীশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, নৌশক্তি এবং সর্বোপরি মোগল রাজদরবারে ‘সুঁই হয়ে ঢুকে’ সুরাট বন্দরে স্থান করে নিয়েছিল। তারপর তো ইতিহাস। দেখতে না দেখতে মোগলরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের পর শাসন ক্ষমতাও চলে যায় ইংরেজের হাতে। মাত্র ১০০ বছরের মধ্যে বিশাল মোগল সাম্রাজ্য পুরোপুরি হয়ে যায় ইংরেজদের উপনিবেশ, যারা দোর্দণ্ডপ্রতাপে শাসন করতে থাকে উপমহাদেশ।

ভারতবর্ষের নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। আধুনিক শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সেনাশাসন, সেক্যুলারিজম, জান্তা, মৌলবাদ নানা টার্ম যুক্ত হয়েছে। বিযুক্ত হয়েছে রাজশাসন (হয়েছে কি?)। ভারত ভেঙে কয়েকটি রাষ্ট্রীয় সীমানা তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রাসাদের অভ্যন্তরে অদৃশ্য শক্তি বিলুপ্ত হয়নি। অতি ছোট প্রাণী টার্ডিগ্রেড যেমন পৃথিবী বারবার ধ্বংস হওয়ার পরও টিকে গেছে, ক্ষমতার পেছনের ক্ষমতাও তেমনি বহাল রয়েছে। ধরন ও অবয়ব পাল্টেছে মাত্র। আগে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল ছিল রাজপ্রাসাদ, যা কিছু সিদ্ধান্ত হতো, তা ওই রাজপ্রাসাদের দেওয়ালের অভ্যন্তরেই। সে কারণেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শব্দটি চালু হয়েছে। দেশের সৈন্যবাহিনী যদি কোনো ষড়যন্ত্র করত, তারও উৎপত্তি ও নিয়ন্ত্রণ থাকত প্রাসাদের অভ্যন্তরে। এখন সেই জায়গা বিস্তৃত হয়েছে। আজ আমরা যে একটি রাষ্ট্রের বিশাল প্রশাসন, একদল রাজনৈতিক বেনিফিশিয়ারি, পরিবার, নিকটাত্মীয় দেখতে পাই, তাদের কাছে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে থাকে। মনে হয় যেন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে ওই সিংহাসন। কিন্তু মোটেও তা নয়। একটু গভীরে দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে, কেন্দ্রে থাকা মানুষটিও অনেকটাই অসহায় হয়ে থাকেন। আরেকটু খুলে উদাহরণ দেওয়া উচিত। এখন সুবিধাভোগীরা বসবাস করে জেলা প্রশাসনে, পুলিশ প্রশাসনে, বন্দরে, খাতুনগঞ্জে, বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এই বলয় এত শক্তিশালী যে কোনো শাসক, সে যত শক্তিশালীই হোন আর যত ইচ্ছাই পোষণ করুন, এদের হাত থেকে ১৭ কোটি মানুষকে উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

অবশ্য আরও একটি দুর্বলতা সম্রাট জাহাঙ্গীরদের মতোই আমরা আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতেও দেখতে পাই। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভালোবাসা, স্নেহ, স্বজনের প্রতি অধিক দুর্বলতা, মায়া এসব মানবিক গুণাবলির অংশ। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী আপনজনের প্রতি অন্ধ ভালোবাসার কারণে চরম দুরবস্থায় পড়তে দেখেছি আমরা বহু শাসক, বহু ক্ষমতাধরকে। কারও প্রতি অন্ধত্বের থেকে হত্যাকাণ্ডও ঘটেছে অনেক। ইতিহাস না কপচিয়ে আধুনিক সময়ের কথাই বলি। ভুট্টোপুত্র মুর্তজা ভুট্টোর হত্যার পেছনে ছিল তার মা নুশরাত ভুট্টোর অন্ধ ভালোবাসা; আবার বেনজির ভুট্টোর ক্ষমতাচ্যুতি এবং ঘটনাক্রমে নিহত হওয়ার পেছনে ছিল তার স্বামী আসিফ আলী জারদারির কর্মকাণ্ড, যা নীরবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেনজির মেনে নিতেন। আমাদের দেশেও দেখেছি, এই অন্ধ স্নেহ কারও কারও জন্যে চরম অধঃপতন ডেকে এনেছে।

আবার এসব দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে লাটাই হাতে ঢুকে পড়ে বড় খেলোয়াড়ররা (সুনির্দিষ্ট কোনো সরকারের কথা না, গোটা উন্নয়নশীল বিশ্বই এরকম হয়ে আছে)। ক্ষমতার ঘুড়ি আকাশে ওড়ে। আমরা ঘুড়ি দেখি, অদৃশ্য লম্বা সুতার লাটাই দেখতে পাই না। ঘুড়ি যখন ডানে বায়ে ওপরে নিচে ওঠানামা করে, তখন বুঝি যে দূরে কোথাও লাটাই হাতে কেউ খেলা খেলছে। বিশেষ করে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোতে ঘুড়ি বড় ছটফট করে। যার বর্তমান উদাহরণ পাকিস্তান, মিয়ানমার কিংবা মালদ্বীপ—অথবা আরও দু-একটি দেশ।

প্রসঙ্গান্তর : ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬টি মূল্যবান জীবন গেল বেইলি রোডে। এ ধরনের ঘটনায় আমরা বহুবার দেখেছি, দোকান বা আগুন লাগে যে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানে তার ওপর সব দোষ চাপিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু সরকারের যে সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মানা না মানার বিষয় দেখার কথা, এনফোর্সমেন্ট অথরিটি, তারা কেউ জবাবদিহির মুখোমুখি হয় না! কারণ? যারা নীতিনির্ধারক হয়ে দেশ পরিচালনায় আসেন, তারা এই প্রশাসনকে ঘাঁটান না, ঘাঁটাতে পারেন না, অথবা ঘাঁটাতে চান না। এখানেও নীতিনির্ধারকদের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। এক সময় রাজদণ্ডকে দুর্বল করে দিত যে পারিষদ, তার এখন নাম পাল্টে হয়েছে প্রশাসন।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

লঞ্চের ধাক্কায় নদীতে পড়ে নারী নিখোঁজ

বিএনপিতে যোগ দিলেন জাতীয় পার্টির ২ শতাধিক নেতাকর্মী

ঢাবিতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে জ্ঞান হারালেন ছাত্রী

মে’র তাপমাত্রা নিয়ে ভয়াবহ দুঃসংবাদ

নির্বাহী কমিটির সভা ডেকেছে যুবদল

ধান কাটতে গিয়ে হিটস্ট্রোকে ব্যবসায়ীর মৃত্যু

আগামীকাল দেশের পথে রওনা হচ্ছে এমভি আবদুল্লাহ 

সেই নাবিকদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাল ইরান

কুবি কোষাধ্যক্ষের গাড়ি আটকে দিল শিক্ষক সমিতি

অলৌকিক ‘জাদুর কলের’ দেখা মিলেছে

১০

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজেও ক্লাস শুরু রোববার

১১

অভিভাবক ঐক্য ফোরাম / দাবদাহে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হলে দায় সরকারের

১২

ধান বাঁধছিল রেজাউল, হিটস্ট্রোকে মৃত্যু

১৩

‘১০০ সাংবাদিক হইয়া গেছে, নির্বাচনে আর সাংবাদিক লাগবে না’

১৪

শহীদ শেখ জামালের জন্মদিন রোববার

১৫

নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করায় অর্থদণ্ড

১৬

বর্ষায় দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ করবে ছাত্রদল

১৭

নিভৃতে চলে গেল সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহর মৃত্যু বার্ষিকী

১৮

সিলেটে আবারও নামল স্বস্তির বৃষ্টি

১৯

কুমিল্লায় পানিতে ডুবে ৩ শিশুর মৃত্যু

২০
*/ ?>
X