প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪, ০২:২২ এএম
আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৪, ০৭:২১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জীবিকার চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি!

জীবিকার চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি!

বিভিন্ন যানবাহনে লেখা থাকে, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি। আসলে শুধু সময় নয়, জীবনের মূল্য সবকিছু থেকেই অনেক বেশি। আসলে জীবন অমূল্য। বিজ্ঞান অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে। মানুষের আয়ুও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কিন্তু তারপরও বিজ্ঞান মানুষের জীবন দিতে পারেনি, মানুষকে অমরত্ব দিতে পারেনি। তাই প্রতিটি মানুষের জীবনই আসলে অমূল্য। তাই শুধু সময় নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবিকা—সবকিছুর চেয়ে অনেক অনেক অনেক বেশি। এই বেশির কোনো তুলনা নেই, কোনো মাপকাঠি নেই। এ কারণেই বলা হয়, নিরাপত্তাই প্রথম। আমরা যা কিছুই করি না কেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখতে হবে সবার আগে; যাতে মানুষের জীবন রক্ষার সব ব্যবস্থা নিখুঁত থাকে। কিন্তু আমাদের কাছে যেন জীবন হেলাফেলার বিষয়। আমাদের দেশে মানুষ বেশি, তাই জীবনের দাম যেন এখানে সবচেয়ে কম। আমরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে নানা প্রকল্প বানাই, কিন্তু লাখ টাকা খরচ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে গেলেই আমাদের বাজেটে টান পড়ে। আমরা আসলে নিজেদের জীবন আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়েছি। দুর্ঘটনা না হলে ভাগ্য ভালো। আর না হলে তো বেঁচেই আছি। আল্লাহ আমাদের সহায় আছেন। নইলে ঢাকা যেভাবে বেড়ে উঠেছে, তাতে নিয়মিতই বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটার কথা। আমাদের ভাগ্য ভালো কালেভদ্রে দুর্ঘটনা ঘটে বলে। আমরা লিখি বটে দুর্ঘটনা, কিন্তু এসবই আসলে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু তাতে অত মানুষ মারা যাওয়ার কথা নয়।

একটা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই আমরা সবাই নড়েচড়ে বসি। অনেক হৈচৈ হয়। অভিযানের পর অভিযান চলে। এখন যেমন টার্গেট রেস্টুরেন্ট। বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের সাততলা ভবনে আটটি রেস্টুরেন্ট ছিল। আর রেস্টুরেন্ট ছিল বলেই ৪৬ জন মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ব্যস, এখন সবাই মিলে লেগেছে রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে। রেস্টুরেন্ট পৃথিবীর আদি ব্যবসার একটি। পৃথিবীর সব দেশে, সব প্রান্তেই এ ব্যবসা আছে। কিন্তু রেস্টুরেন্টগুলোকে তো হতে হবে আনন্দের জায়গা, মৃত্যুকূপ নয়। গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটি বাণিজ্যিক ভবনই। কিন্তু তাতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার অনুমোদন ছিল না। রেস্টুরেন্টের সঙ্গে যেহেতু আগুনের সম্পর্ক আছে, তাই রেস্টুরেন্টগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জরুরি। সেই জরুরি কাজটাই আমরা করি না। জরুরি তো দূরের কথা, ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আমরা নিই না। গ্রিন কটেজে ফায়ার এক্সিট থাকলে ৪৬ জন মানুষকে প্রাণ দিতে হতো না। গ্রিন কটেজে কেউ কিন্তু আগুনে পুড়ে মারা যায়নি। সবাই মারা গেছে ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে না পেরে। বেরোনোর একটা জায়গা বা খোলা হাওয়া থাকলেই মানুষগুলো বেঁচে যেতে পারত। রেস্টুরেন্টগুলোকে সুন্দর করার জন্য আমরা কাচ দিয়ে ঢেকে দিই, যাতে বাতাস ঢুকতে না পারে।

বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পর এখন গণমাধ্যমে হাজার হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা ছাপা হচ্ছে, একের পর এক অভিযান হচ্ছে। কিন্তু এ ভবনগুলো হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে গজায়নি বা হঠাৎ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। দিনের পর দিন এ ভবনগুলো লেগেছে বানাতে। বছরের পর বছর এ ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে আমাদের চোখের সামনে। শতবছরের পুরোনো কোনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হলে সেটা মানা যায়। একে তো বয়স হয়েছে, দ্বিতীয়ত, তখন অত আইনকানুনের বালাই ছিল না। এখন তো শুধু আইন নয়, আইনের বেড়াজাল আছে। একটা ভবন বানাতে কতটুকু জায়গা ছাড়তে হবে, কতটুকু উঁচু হবে, কী ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে; সবই তো লেখা আছে। রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর—সাত ঘাটের পানি খেয়েই তবে একটি ভবন ওঠার কথা। তাহলে কি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর অনুমোদন নেই? আমার ধারণা সব ছাড়পত্রই আছে। তারা সাত ঘাটের পানি খেয়েছে আর ‘কর্তৃপক্ষ’ খেয়েছে ঘুষ। ব্যস, তাতেই সাধারণ ট্রেড লাইসেন্সেই চলছে সব ধরনের ব্যবসা। বাণিজ্যিক ভবনের সুবাদে তাতে বসে যাচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্ট। এখন আগুন লাগার পর সবার ঘুম ভেঙেছে। অভিযান চলছে। এরই মধ্যে ৪০টি রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেন সব দোষ রেস্টুরেন্টের। কাল শপিং মলে আগুন লাগলে শপিং মলে অভিযান শুরু হবে। পরশু পুরান ঢাকায় আগুন লাগলে রাসায়নিকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে। এ অভিযান আসলে আইওয়াশ। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা। সরকার দেখাচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে তাদের অনেক উদ্বেগ। সরকারও জানে, কদিন পর মানুষ ভুলে যাবে। তারপর অভিযান থেমে যাবে। আবার সবকিছু চলবে আগের মতোই। আমরা সবাই অপেক্ষা করব আরেকটি দুর্ঘটনার জন্য। চলমান অভিযানে এক নারী ম্যাজিস্ট্রেট সাংবাদিকদের বলছিলেন, এটা আমাদের নিয়মিত অভিযানের অংশ। নিয়মিতই যদি হবে, তাহলে এতদিন অভিযান হয়নি কেন? কেন বছরের পর বছর এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চলল।

কবি নাজিম হিকমত তার বিখ্যাত কবিতা জেলখানার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ কিন্তু এই সুপারফাস্ট একবিংশ শতাব্দীতে শোকের কোনো আয়ু নেই। বড়জোর একটা ইস্যু। গত বৃহস্পতিবার রাতে আগুনে ৪৬ জন মারা গেছেন। পরদিন শুক্রবার বিপিএলের জমজমাট ফাইনাল হয়েছে, তাতে আতশবাজি হয়েছে, বইমেলা হয়েছে, অনেক পিকনিক হয়েছে, সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রীরা শপথ নিয়েছেন। সবকিছুই স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি, কেউ মারা যায়নি।

এ অভিযানেই কি ঢাকা নিরাপদ হয়ে যাবে? ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভাঙা হবে বা নিরাপদ হবে? আমি জানি কিছুই হবে না। নতুন কোনো ইস্যু এসে বেইলি রোডকে আড়াল করলেই ‘নিয়মিত অভিযান’ বন্ধ হয়ে যাবে। আবার জমবে মেলা। আবার চলবে রেস্টুরেন্ট। আবার চুলার নিচেই থাকবে গ্যাসের সিলিন্ডার নামের বোমা। সিঁড়িগুলো হবে রেস্টুরেন্টের স্টোররুম বা এক্সট্রা কিচেন।

একেকটা দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা অনেক হৈচৈ করি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। নিমতলী-চুড়িহাট্টার আগুনের পরও পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরেনি। এফ আর টাওয়ারের আগুনও আমাদের বহুতল ভবনগুলোকে নিরাপদ করতে পারেনি। বেইলি রোডের আগুনও আমাদের রেস্টুরেন্টগুলোকে নিরাপদ করতে পারবে না। রানা প্লাজার ধসের ঘটনা আমাদের গার্মেন্টস শিল্পকে এক ধাক্কায় নিরাপদ করে দিয়েছিল। কারণ চাপটা এসেছিল বিদেশ থেকে। নিরাপদ কারখানা না হলে বিদেশিরা পোশাক কিনবে না, পরিস্থিতি এ পর্যায়ে যাওয়ার পরই শুধু আমাদের গার্মেন্টস মালিকরা নিরাপত্তার পেছনে টাকা খরচ করেছেন। এখন আমাদের রেস্টুরেন্টের ওপর সেই চাপটা কারা দেবে, কারা তাদের বাধ্য করবে। রাজউক, সিটি করপোরেশন, পুলিশ এখন যেই ‘নিয়মিত অভিযান’টা চালাচ্ছে; সেটা যদি সত্যি সত্যি নিয়মিত হয়, তাহলে হয়তো পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। কিন্তু তেমন আশা দেখতে পাচ্ছি না। অভিযানের নামে আসলে রমজানের আগে আগে কারও কারও বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা হলো।

এমন কোনো অভিযান শুরু হলেই সামনে আসে জীবিকার প্রশ্ন। একের পর এক রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেলে মালিকদের কী হবে, কর্মচারীদের কী হবে—এ নিয়ে আলোচনা হবে। জীবিকাটা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু সেটা যেন জীবনের বিনিময়ে না হয়। জীবন সবকিছুর আগে। আমরা যাই করি, নিরাপত্তার ধারণাটা যেন সবার আগে থাকে। ব্যবসা হবে, রেস্টুরেন্ট ব্যবসাও হবে। তা যেন নিয়ম মেনে হয়। ব্যয় যাই হোক, নিরাপত্তায় যেন কোনো ঘাটতি না থাকে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জিপিএ-৫ পেল মেয়ে, দুশ্চিন্তায় রিকশাচালক পিতা

মুখস্থ শিক্ষার ওপর নির্ভরতা কমাতে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা হচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী

রাশিয়ায় ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, নিহত ৭

বহুমুখী শিক্ষায় সীমাখালী ইসলামিয়া ক্যাডেটের ঈর্ষণীয় সাফল্য

অংকে ফেল করায় গলায় ফাঁস নিল কিশোরী

ইসরায়েলে পুলিশ-জনগণ সংঘর্ষ, ভয়ংকর বিপদে নেতানিয়াহু

পা দিয়ে লিখেই এসএসসি পাস করল সিয়াম

দোয়া কুনুত বাংলা উচ্চারণ ও অর্থসহ

গ্রিন রোড থেকে রিকশার গ্যারেজ উচ্ছেদ, যান চলাচলে ফিরেছে স্বাচ্ছন্দ্য

মাগরিবের নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

১০

‘তাপমাত্রা কমাতে নগর বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে’ 

১১

চাশতের নামাজের নিয়ম, নিয়ত ও ফজিলত

১২

মা দিবসে এক ফিলিস্তিনি মায়ের সংগ্রামের গল্প

১৩

ছেলের সঙ্গে এসএসসি পাস করলেন দুই ইউপি সদস্য মা ও খালা

১৪

মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ছাত্রলীগের অভিনন্দন 

১৫

‘গরবিনী মা’ সম্মাননা পেলেন ১১ মা

১৬

এশার নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

১৭

নবীনদের চাকরির সুযোগ দিচ্ছে আখতার গ্রুপ

১৮

যোহরের নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

১৯

বিএনপি নেতার কাছে ‘বিক্রি’ আ.লীগ-জাপার তিন প্রার্থী

২০
X