নিজামুল হক বিপুল
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৪, ০২:২৭ এএম
আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৪, ০৭:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বেইলি রোড ট্র্যাজেডি অগ্নিকাণ্ড নয়, হত্যাকাণ্ড

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন। ছবি: কালবেলা
বেইলি রোড ট্র্যাজেডি অগ্নিকাণ্ড নয়, হত্যাকাণ্ড

রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবন গ্রিন কোজি কটেজে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নারী, পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে ৪৬ জন মানুষ নাই হয়ে গেছেন। কেউ কেউ গোটা পরিবারশুদ্ধ নাই হয়ে গেছেন। নাই মানে একেবারে নাই। তারা প্রত্যেকে আকাশের তারা হয়ে গেছেন। তাদের এই মৃত্যুতে একেকটি স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটেছে। মর্মান্তিক এই ঘটনার পর চলছে নানান বিচার-বিশ্লেষণ। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তর, পরিদপ্তর একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের ত্রুটিগুলো আড়াল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু যারা মারা গেছেন তারা আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারের গোটা ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছেন। কেন এবং কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছেন সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।

অনেকেই বলছেন, আহারে এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটল যে, এক নিমিষেই চোখের সামনে সব শেষ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও যেখানে লোকে লোকারণ্য ছিল, গমগম করছিল, আনন্দ-উল্লাসে সবাই মেতেছিল, পুরো ভবন ছিল ঝলমলে। কিন্তু মুহূর্তেই সেখানে পৃথিবীর তাবৎ অন্ধকার নেমে এসেছে। মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে আলোকজ্জ্বোল বহুতল ভবনটি। যেটি এখন পুড়ে যাওয়া কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটিকে প্রায় সবাই দুর্ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও আমার কাছে এটি স্রেফ একটি ‘পরিকল্পিত’ ও ‘দায় দায়িত্বহীন’ হত্যাকাণ্ড। হ্যাঁ, ঠিকই বলছি, এটি একেবারেই একটি হত্যাকাণ্ড।

এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমাদের এই দেশে, এই শহরে আরও বেশ কয়েকবার ঘটেছে। কামাল আতার্তুক অ্যাভিনিউয়ের এফআর টাওয়ার, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটি গার্মেন্টস কারখানা কিংবা মহাখালী খাজা টাওয়ার। শুধু এগুলোই নয়, নিমতলী, চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির ক্ষত এখনো শুকোয়নি। এরকম আরও অনেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আছে। বর্ণনা দিলে শুধু তালিকা দীর্ঘ হবে আর হাহাকার বাড়বে। এসব ঘটনার বেশিরভাগেরই এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি। ঘটনা ঘটার পর তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকদিন তোড়জোড় চলে। মামলা হয়, কিছু লোককে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তারপর আরেকটি ঘটনার ভিড়ে পেছনের ঘটনা হারিয়ে যায়।

মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিরীহ সাধারণ মানুষের প্রাণ গেলেও যাদের কারণে এই দুর্ঘটনা এবং এত এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে তারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের টিকিটির নাগালও পাওয়া যায় না।

গত শনিবার (২ মার্চ) সংসদে দেওয়া বক্তব্যে তৎকালীন গৃহায়ন ও পণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের পর বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে রাজধানীর ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার পাশাপাশি এফআর টাওয়ারের ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নেওয়ার উদ্যোগ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ওই ঘটনায় ৬২ জনকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, অনেককেই মামলা থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি চূড়ান্ত অভিযোগপত্রে অনেকের নাম বাদ দেওয়া হয়। আর মামলার কার্যক্রম তো আজও শুরু হয়নি।

এবার আসা যাক বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডকে দুর্ঘটনা না বলে কেন হত্যাকাণ্ড বলছি। যে ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সেখানে ১০টি রেস্টুরেন্ট ছিল। শহরের নামিদামি এসব রেস্তোরাঁ কোনো রকম নিয়কানুন না মেনেই শুধু কাঁচা টাকা কামানোর জন্য যেনতেনভাবে ব্যবসা করে আসছিল। ভবন ঠিক আছে কি না? এটিতে রেস্তোরাঁ ব্যবসা চালানোর মতো অবস্থায় ছিল কি না? এসবের কোনো কিছুই পরোয়া করেননি ব্যবসায়ীরা। তারা শুধু নিজেদের ব্যবসার কথা চিন্তা করেছেন। তাই এটিকে হত্যাকাণ্ড বললে খুব বেশি অতিরঞ্জন হবে না।

শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারবেন না সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা। প্রথমত, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এই ভবনটি অনুমোদন দিয়েছে আবাসিক ভবন হিসেবে। সেটি কীভাবে বাণিজ্যিক হয়ে গেল? এই প্রশ্নের জবাব রাজউককেই দিতে হবে। ভবনটি নির্মাণের পর সেটি কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে তার খোঁজ-খবর নেওয়ার দায়িত্ব রাজউকের। না হলে ধরে নিতে হবে, তারা সেটি করেনি বা করে থাকলেও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করেছে।

গ্রিন কোটি কটেজে যে এত রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে সেটি কিন্তু আড়ালে, গোপনে হয়নি। এর জন্য সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়েছে। ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা কি ভবনটি পরিদর্শন করে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছেন, কিংবা কী ব্যবসা করবেন সে বিষয়ে জেনে লাইসেন্স দিয়েছেন কি না?

লাইসেন্স দেওয়ার সময়ই তাদের নিশ্চিত করা দরকার ছিল যে, যিনি লাইসেন্স নিচ্ছেন তিনি ভবনটিতে কীসের ব্যবসা করবেন? যদি রেস্তোরাঁর ব্যবসা করেন তাহলে ভবন পরদির্শন করে তবেই ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া উচিত ছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ কোনো রকম সরেজমিন তদন্ত না করেই লাইসেন্স দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, লাইসেন্স দেওয়ার পরও তারা পরিদর্শন করেননি। না হলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটরার সুযোগই তৈরি হতো না। তাই মানবসৃষ্ট এই হত্যাকাণ্ডের দায় কোনো ভাবেই এড়াতে পারবেন না সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। আর ফায়ার সার্ভিস। তাদের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে তিনবার এই ভবন কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা আমলে নেননি। এটা খুবই হাস্যকর। কারণ ফায়ার সার্ভিসের এই ক্ষমতাটুকু আছে যে, কোনোভবন ঝুঁকিপূর্ণ হলে তারা সেটি সিলগালা করতে পারবেন। তিনবার নোটিশ দেওয়ার পরও যখন কর্তৃপক্ষ কানে নেয়নি, তখন ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ ভবনটি সিলগালা করে দিলে আজ এত প্রাণ অকালে ঝরে যেত না। এই জায়গা থেকে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষও কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না।

এসব কিছু বিবেচনায় নিলে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড যে ‘হত্যাকাণ্ড’ সে বিষয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। তাই এমন মানবসৃষ্ট হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকারকে কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে এফআর টাওয়ার থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকার যেসব বহুতল ভবনে আগুন লেগেছে, সেগুলোর জন্য প্রকৃত দায়ীদের (তারা যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন) আইনের আওতায় এনে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এরকম ঘটনা রোধ করা যাবে না। বরং বারংবার এমন ঘটনা ঘটবে, মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হবে। আর আমরা শুধু সব শেষ, সব শেষ বলে হাপিত্যেশ করব।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাইসির সঙ্গে হেলিকপ্টারে আর যারা ছিলেন

উন্নয়নের নামে রাতের আঁধারে শাহবাগে গাছ কাটার অভিযোগ

সবশেষ বিহারে ছিলেন এমপি আনার

‘অভিবাসী কর্মীদের জন্য আরও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করছে সরকার’

ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিখোঁজ, যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র

স্বামীর মোটরসাইকেলের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নারীর মৃত্যু

তবুও প্রার্থী হলেন সেই নাছিমা মুকাই 

গাজীপুরে কারখানার ১০ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে নারী শ্রমিকের মৃত্যু

রাজশাহীতে আগুনে পুড়ে ছাই ১০ বিঘার পানের বরজ

বিয়েবাড়ি থেকে কনের পিতাকে তুলে নিয়ে টাকা দাবি

১০

ঠাকুরগাঁওয়ে নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর , এলাকায় উত্তেজনা

১১

ঈশ্বরদীতে ফেনসিডিলসহ রেল নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহি আটক

১২

এমপি আনোয়ার খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ওসিকে নির্দেশ

১৩

উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ১১৬ কোটিপতি প্রার্থী : টিআইবি

১৪

রাইসির জন্য দোয়ার আহ্বান

১৫

‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুদৃঢ় হয়েছে’ 

১৬

প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা সিটির কাছেই থাকল

১৭

বাংলাদেশকে লক্কড়ঝক্কড় দেশে পরিণত করেছে আ.লীগ : প্রিন্স

১৮

২০৩০ সালে সাড়ে ৫২ লাখ যাত্রী বহন করবে মেট্রোরেল  

১৯

পেনিনসুলা স্টিলের এমডিসহ চারজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

২০
X