মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪, ০৩:৪৩ এএম
আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২৪, ০৮:২৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পবিত্র রমজানে জুমার তাৎপর্য

পবিত্র রমজানে জুমার তাৎপর্য

আত্মশুদ্ধি ও জীবন সংস্কারের মাস পবিত্র মাহে রমজান। রমজানে ইবাদত করলে সওয়াব বেশি। রমজানে ইবাদত সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক আদম সন্তান ভালো কাজের প্রতিদান দশ থেকে সাতশগুণ বেশি পাবে। রোজা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ নিজেই এর প্রতিদান দেবেন। (মুসলিম, হাদিস: ২৭০৭)। এদিকে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিন যখন নামাজের আহ্বান জানানো হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে (মসজিদে) এগিয়ে যাও এবং বেচাকেনা (দুনিয়াবি যাবতীয় কাজকর্ম) ছেড়ে দাও। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর; যদি তোমরা জানতে।’ (সুরা জুমা, আয়াত: ৯)। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এক হাদিসে বলেছেন, মুমিনের জন্য জুমার দিন হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১০৯৮)। এ ছাড়া নবী (সা.) অন্য এক হাদিসে এরশাদ করেছেন, যে দিনগুলোতে সূর্য উদিত হয়, ওই দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। ওইদিন হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। ওইদিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং ওইদিনই তাকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়। আর ওইদিনই কেয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। (মুসলিম, হাদিস: ৮৫৪)। তিনি আরও বলেছেন, মহান আল্লাহর কাছে জুমার দিনটি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনের মতো শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনটি আল্লাহর কাছে অতি মর্যাদাসম্পন্ন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১০৮৪)

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষিত একটি পবিত্রতম দিন জুমাবার। প্রতি মাসে চার-পাঁচবার এবং বছরে প্রায় বায়ান্নবার পবিত্র এ দিবসটির আগমন হয়। মহান রবের ঘোষিত অনুপম মর্যাদার শ্রেষ্ঠ দিন-রাতগুলোয় ইবাদত করার প্রত্যয় প্রকৃত মুমিন মুসলিমগণকে তিনশ চৌষট্টি দিনের প্রহর গুনতে হলেও সপ্তাহের পালাক্রমে চলমান শুক্রবার তথা জুমাবারের জন্য মাত্র ছয়টি দিন অপেক্ষা করতে হয়। মহান রাব্বুল আলামিন মাত্র ছয় দিনে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেন, যা পরিপূর্ণতায় বিকশিত হয় সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবারে। এই মর্মে পবিত্র কোরআনে কয়েকটি আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা রয়েছে। প্রখ্যাত তাফসির বিশারদ আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.)-এর সহিহ বর্ণনায় জানা যায়, ছয় দিনে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে তা রোববার থেকে শুরু করে শুক্রবারে শেষ হয়। আবার পৃথিবী ধ্বংস তথা কেয়ামত সংঘটিত হবে ঠিক শুক্রবার। এই দিনে হজরত (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই দিনে হজরত আদম (আ.) এবং মাতা হাওয়া (আ.)-কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছিল এবং এই দিনেই তাদের দুজনকে পৃথিবীর দুটি অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়েছিল। হজরত আদম (আ.)-কে শাস্তিস্বরূপ রাখা হয়েছিল শ্রীলঙ্কায় এবং মাতা হাওয়া (আ.)-কে রাখা হয়েছিল সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে। আবার এই দিনেই তাদের দুজনকে মহান রাব্বুল আলামিন ক্ষমা করে দিয়ে একত্র করে দিয়েছিলেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। এদিন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এদিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এদিন সেখান থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে, জুমার দিনই কেয়ামত সংঘটিত হবে। (মুসলিম: ১৮৬২)

একজন মানুষের জীবদ্দশায় যতবার সূর্যোদয় হবে এবং যতগুলো সকাল ভাগ্যে জুটবে তার মধ্যে সবচেয়ে মহিমাপূর্ণ দিনটি সে পাবে শুক্রবার তথা জুমার দিন। একটি দিন বলতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়কে বোঝায়। এর অর্থ, সকল প্রকার ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল ইবাদতের জন্য এই দিনটি সর্বোৎকৃষ্ট ও মঙ্গলজনক। আরবি জুমা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো একত্রিত করা। আগের যুগে এই দিনকে ‘উরুবা’ বলা হতো। জুমার দিনে চার ওয়াক্ত ফরজ নামাজের সঙ্গে জোহরের নামাজের পরিবর্তে দুই রাকাত সালাত আদায় করা ফরজ এবং খুতবা পাঠ ও শোনা ওয়াজিব হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। জুমার সালাত ফরজ হয় প্রথম হিজরিতে। রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরতকালে কুবাতে অবস্থান শেষে শুক্রবার দিনে মদিনা পৌঁছেন এবং বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় পৌঁছে জোহরের ওয়াক্ত হলে সেখানেই তিনি জুমার সালাত আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার সালাত। জুমার নামাজের বিষয় পবিত্র কোরআনে সুরা জুমার ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে দ্রুত করো এবং কেনাবেচা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বোঝো। অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা জুমা, আয়াত : ৯-১০)

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ১১৪টি সুরার মধ্যে পৃথক ও স্বাতন্ত্র্য একটি সুরা নাজিল করেছেন, যা নামকরণ করা হয়েছে ‘সুরা জুমা’ নামে। যেমন মহান আল্লাহ মুমিনদের উদ্দেশ্য করে শুক্রবার আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেনাবেচা বন্ধসহ দুনিয়াবি সব কাজ পরিত্যাগ করে নামাজের উদ্দেশে ছুটতে আদেশ করেছেন এবং এও বলেছেন, নামাজ শেষে আবার তোমরা স্বকর্মে ছড়িয়ে পড়ে দিনটিতে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো। তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, মুসলিম সমাজে শয়তানের প্ররোচনায় কিছু মানুষ শুক্রবার দিনটিকে এমনভাবে বিমুখীকরণ করে রেখেছে, যার অন্ত নেই। লক্ষ করলে দেখা যাবে, সপ্তাহের ছুটির দিন হলো শুক্রবার আর যে কারণে এই দিনে কেনাবেচা সবচেয়ে বেশি জমজমাট থাকে। এই উপমহাদেশে পশ্চিমা বণিকরা কেনাবেচার উদ্দেশ্যে এসে গোড়াপত্তন করেই শেষ হয়নি, বরং কয়েকশ বছর শাসনের নামে শোষণ করে অমুসলিম কালচারের বীজ বপন করে যায়। সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে কোরআনে যে ব্যাপারে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে, আজকের মুসলিম সমাজ শুক্রবারের জুমার আজান হওয়ার পরেও সেই হাটবাজারে ব্যস্ত হয়ে থাকে।

এই দিনটি মুসলমানের জন্য বিশেষ মহিমাপূর্ণ, যা মহান আল্লাহ খুশি হয়ে মুসলমানদের দান করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তীদের জুমার দিন সম্পর্কে সঠিক পথের সন্ধান দেননি বিরোধে লিপ্ত হওয়ার কারণে। তাই ইহুদিদের জন্য শনিবার, খ্রিষ্টানদের জন্য রোববার এবং মুসলিমদের জন্য জুমার দিন নির্ধারণ করলেন। তিনি জুমার দিন, শনি ও রোববার এভাবে বিন্যাস করলেন যে, ওইসব জাতি কেয়ামতের দিন আমাদের পশ্চাৎবর্তী হবে। আমরা পৃথিবীবাসীর মধ্যে শেষে আগমনকারী উম্মত এবং কেয়ামতের দিন হব সর্বপ্রথম। যাদের সমগ্র সৃষ্টির সর্বপ্রথম বিচার অনুষ্ঠিত হবে।’ (মুসলিম : ১৮৬৭)। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের জন্য জুমার দিন বরাদ্দ করলেও তারা বেছে নিয়েছে শনি ও রোববার। এজন্য মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে তাদের জন্য লানত নির্ধারণ করলেন। অতএব যারা মুসলিম হয়েও ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মতো শুক্রবারের মর্যাদা রক্ষায় গাফিলতি করবে কিংবা ইহুদি-খ্রিষ্টানের মতো এই দিনটিকে পরিত্যাগ করবে, তারাও তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।

জুমার দিন ভাগ্যবান মুসলমানদের জন্য ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া-দরুদের সুবর্ণ সুযোগ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে উত্তম পোশাক পরিধান করবে এবং সুগন্ধি ব্যবহার করবে, যদি তার কাছে থাকে। তারপর জুমার নামাজে যাবে এবং অন্য মুসল্লিদের গায়ের ওপর দিয়ে টপকে সামনের দিকে না যায়। নামাজ আদায় করে। তারপর ইমাম খুতবার জন্য বের হওয়ার পর থেকে সালাম পর্যন্ত চুপ করে থাকে। তাহলে তার এই আমল পূর্ববর্তী জুমার দিন থেকে পরের জুমা পর্যন্ত সব সগিরা গুনাহর জন্য কাফফারা হবে।’ (আবু দাউদ: ৩৪৩)। আবু হুরায়রা (রা.) আরও বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের সঙ্গে একদিন শুক্রবারের ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, সেই সময়টায় যদি কোনো মুসলিম নামাজ আদায়রত অবস্থায় থাকে এবং আল্লাহর কাছে কিছু চায়, আল্লাহ অবশ্যই তার সে চাহিদা বা দোয়া কবুল করবেন।

এরপর রাসুল (সা.) তার হাত দিয়ে ইশারা করে সময়টির সংক্ষিপ্ততার ইঙ্গিত দেন (বোখারি)। ফিকহ শাস্ত্রবিদগণ জুমার দিন দোয়া কবুলের সময়টা আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত বলে ব্যাখ্যা করেছেন। সুতরাং এ দিনে যত পারি ইবাদত করি, বেশি বেশি সালাত আদায় করি, জিকির করি, দোয়া-দরুদ পাঠ করি, মহান রবের খুশিতে অন্তরে পরকালের ভয় এনে ইসলাম পরিপন্থি কাজ প্রত্যাখ্যান করি। মহান আল্লাহ সবাইকে তাওফিক দিন।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ছাত্রলীগের ওপরে কোনো সন্ত্রাস নেই, ছাত্রলীগ নেতার বক্তব্য ভাইরাল

টাইগারদের বিশ্বকাপ দল ঘোষণা

মার্কিন কোনো ইস্যুকেই কেয়ার করি না : ওবায়দুল কাদের

সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টান্টবাজি করে অতিরিক্ত পপুলার হতে নাই : হিল্লোল

প্রথমবারের মতো বড় পর্দায় আসছে কাজী নজরুলের জীবনী

নির্ধারিত সময়ে হচ্ছে না বিশ্বকাপের দল ঘোষণা

২৩ নাবিক নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে এমভি আবদুল্লাহ

নির্বাচনী সভার বিরিয়ানি মাদ্রাসায় দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট

আবহাওয়ায় শুধুই দুঃসংবাদ

বিদায়বেলায় এমবাপ্পে-খেলাইফির হাতাহাতি!

১০

গাজায় যাওয়া ট্রাকভর্তি ত্রাণ ফেলে দিচ্ছে ইসরায়েলিরা

১১

হাইকোর্টে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন বিএনপি নেতা আলাল

১২

ঢাকায় ডোনাল্ড লু

১৩

এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

১৪

ফ্রান্সের মৌসুম সেরা ফুটবলার এমবাপ্পে

১৫

ডিএমপির মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার ৩৬

১৬

কৃষ্ণচূড়ার টুকটুকে লাল ফুলে সেজেছে প্রকৃতি

১৭

সাংবাদিকতা ও মিডিয়ার সেরাদের অ্যাওয়ার্ড দেবে ডিজিটাল মিডিয়া ফোরাম

১৮

বিদেশ ফেরতদের পাশে থাকার আহ্বান

১৯

সৌদি পৌঁছেছেন ১৫৫১৫ হজযাত্রী

২০
X