ড. সজল চৌধুরী
প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৪, ০২:৪০ এএম
আপডেট : ০৪ মে ২০২৪, ০৮:২১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্থাপনা নির্মাণে পরিবেশগত গুরুত্ব থাকতে হবে

স্থাপনা নির্মাণে পরিবেশগত গুরুত্ব থাকতে হবে

প্রথমেই আসা যাক বর্তমান পরিবেশগত অবস্থা নিয়ে। বর্তমান তাপপ্রবাহে মানুষের জীবন দুর্বিষহ যে পর্যায়ে নিয়ে গেছে, এটি সহজেই অনুমেয় ভবিষ্যতে আমাদের বসবাসের পরিবেশ আমাদের প্রজন্মের ওপর কোন বিরূপ প্রভাব ফেলবে! শহরের যে প্রান্তেই তাকানো যাক, শুধু দেখা যায় বড় বড় কাচের বাক্স! বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবা যাক। কিছুদিন আগেও পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ নগর ও শহরাঞ্চলে বসবাস করত। সদ্য পেরিয়ে আসা ২০২০ সালের মধ্যেই শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৪.৫ বিলিয়নে পৌঁছে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ধারা এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের শহরগুলোর মোট জনসংখ্যা দাঁড়াবে পাঁচ বিলিয়নের ওপর। দ্য জার্নাল অব দি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস-এ প্রকাশিত ‘দ্য নেক্সট বিল্ট এনভায়রনমেন্ট, টুডে’-এর তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৯ শতক বিলিয়ন স্কয়ার ফুট নতুন জায়গার প্রয়োজন হবে বিশ্বব্যাপী নতুন স্থাপনা তৈরি করতে, যার মধ্যে পুরোনো ভবনগুলোর পুনর্নির্মাণও বিদ্যমান। নতুন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় এ জায়গার পরিমাণ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনাগুলোয় ব্যবহৃত সব জায়গার প্রায় তিনগুণ।

সুতরাং এটি সহজেই অনুমেয় যে, বিশ্বব্যাপী শহরগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ ভবিষ্যতে শহরগুলোকে কোনদিকে নিয়ে যাবে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের সঙ্গে শহরগুলোয় বসবাসরত মানুষজনের জীবন-জীবিকা এবং স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো কীভাবে সমাধান হবে? বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোয় কীভাবে এ বর্ধমান চাপ সামলানো সম্ভব হবে? একটু অন্যভাবে বললে যারা স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ কিংবা প্রকৌশলী তাদের চিন্তা-চেতনায় কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব পেলে এবং বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে কোনদিকে অগ্রসর হলে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর টেকসই উন্নয়ন বাস্তবসম্মত এবং সম্ভবপর হবে। ধারণা করা যায়, ব্যাপারগুলো অতটা সহজ নয়। কারণ এখানে শুধু একটি বিষয় জড়িত নয়। এখানে জড়িত রয়েছে মানুষের জীবনধারণের প্রত্যেকটি পর্যায় প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে। অন্যদিকে, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনগুলোয় দেখা যায়, বিভিন্ন দেশ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানোর জন্য বছরান্তে বিভিন্ন ধরনের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এমনকি কলকারখানাকে পুনর্নির্মাণ করে, বিভিন্ন স্থাপনাকে শক্তিসাশ্রয়ী হিসেবে গড়ে তুলতে কিংবা নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে অনেক ধরনের পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার কার্বন নিঃসরণ অনেক দেশ কমাতে সক্ষম হয়েছে। কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের স্থানীয় জলবায়ুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে স্থাপনাগুলোকে কীভাবে শক্তিসাশ্রয়ী করা যায়, সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের রেটিং সিস্টেমের প্রচলন করেছে।

উদাহরণ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার কথা বলা যেতে পারে। এখানে স্বভাবত যে কোনো স্থাপনাকে প্রাথমিকভাবে ছয় মাত্রার রেটিং সিস্টেমে আসতে হয়। পরে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে রেটিং সিস্টেমের মানোত্তীর্ণ হতে হয়। যেমন ছয় থেকে আট মাত্রার রেটিং সিস্টেম, সেখানে সর্বোচ্চ ১০ মাত্রার রেটিং সিস্টেম পর্যন্ত আসা যায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে। এগুলো সাধারণত সরকারিভাবে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে আসছে, যাদের নিজস্ব একটি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা তৈরির কোড আছে। যে কোড সময়ে সময়ে জলবায়ু এবং পরিবেশের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তনশীল, যা নতুন কিংবা পুরোনো স্থাপনাটি বছরান্তে কত মাত্রায় শক্তিসাশ্রয় করবে, তার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন ধরনের স্থাপনার জন্য বিল্ডিং কোড এবং সেই কোডগুলোকে সঠিক পর্যায়ে পর্যালোচনা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল সফটওয়্যার, অ্যাপস, ক্যালকুলেটরের উদ্ভাবন করেছে। আর সেসব প্রযুক্তির মান উন্নয়নের জন্য দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণাগার ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে বছরব্যাপী। এমনকি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ বিষয়গুলোকে খুব সহজ এবং সুন্দরভাবে জানার জন্য অনেক ধরনের ওয়েবসাইটও বিদ্যমান। ওয়েবসাইটগুলোর মাধ্যমে স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী থেকে শুরু করে একজন সাধারণ নাগরিক স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে কীভাবে সেটিকে পরিবেশবান্ধব করা যায় এবং পরে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, সেসব বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে খুব সহজেই। যেখানে সৌরশক্তিকে কীভাবে আবাসনে ব্যবহার করলে কিংবা স্থাপনা তৈরির উপকরণগুলো কীভাবে ব্যবহার করলে পরিবেশবান্ধব হবে অথবা পুরো স্থাপনাটি বছরান্তে কতটুকু শক্তিসাশ্রয় করতে পারবে, এসব বিষয়ে এখন প্রায় প্রত্যেকটি উন্নত দেশই সচেতন।

যদিও এরই মধ্যে আমাদের দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষেত্রবিশেষে পরিবেশবান্ধব স্থাপনা তৈরির বিভিন্ন ধরনের কোড এবং প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে কিংবা হচ্ছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে সেগুলোর বাস্তবায়ন যত দ্রুতগতিতে আমরা করতে পারব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গলকর হবে। এ ধরনের পরিবেশবান্ধব স্থাপনা তৈরির কোড নিরূপণে প্রয়োজন আমাদের নিজস্ব গবেষণা। যেখানে আমাদের নিজস্ব জলবায়ু, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এ কোডগুলোকে সম্পর্কযুক্ত করতে হবে। কারণ অন্যান্য দেশের কোডগুলো না বুঝে ব্যবহার করলে কিংবা অনুসরণ করলে সেখান থেকে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় লক্ষ্যে কখনোই পৌঁছাতে পারব না। এমনকি সেগুলো পরে বিভিন্ন সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তা ছাড়া আমাদের দেশের এ ধরনের পরিবেশবান্ধব রেটিং সিস্টেম কিংবা কোড তৈরির লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত সঠিক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ছোট আকারে হলেও গবেষণা চালাতে হবে। কারণ সঠিক পর্যালোচনা, দিকনির্দেশনা এবং গবেষণা ছাড়া আমরা যেমন সমস্যাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারব না, তেমনি সম্মিলিতভাবে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে এ ধরনের কাজকে সফল করার লক্ষ্যে। যেখানে বিশেষজ্ঞ স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলীদের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী, পরিবেশবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত জড়িত থাকতে পারেন। কারণ নাগরিকদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পরিবেশবান্ধব অনেক সমস্যার নতুন সমাধান হতে পারে, যা টেকসই নগরায়ণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তা ছাড়া বছরান্তে আমাদের দেশের শহরগুলোয় আবাসনগুলো কিংবা বিভিন্ন ভবন থেকে কী পরিমাণ শক্তি খরচ হয়, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা প্রয়োজন। কারণ এ ধরনের সঠিক তথ্য আমাদের না জানা থাকলে ভবিষ্যতে সেসব স্থাপনা থেকে শহরকেন্দ্রিক কতটুকু শক্তিসাশ্রয় করা সম্ভব হবে, তা নির্ধারণ করা কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না। এসব বিষয়ে আমাদের দেশের বিভিন্ন শহরকেন্দ্রিক একটি ডাটাবেজ তৈরি করা প্রয়োজন। এমনকি ভবনভেদে শক্তিসাশ্রয়ের মাত্রা কেমন হবে, পরে সেসব বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও এ ধরনের তথ্যগুলো অনেক কাজে দেবে। আগামী ২০৩০ সালের জন্য দেশের স্থাপনাগুলোয় শক্তিসাশ্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রস্তুত করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে আমাদের। সেই লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশের প্রতিটি বড় বড় শহরের জন্য ভিন্ন হবে সেখানকার পরিবেশ এবং বাস্তবতার নিরিখে। কারণ একটি শহরের অবকাঠামোগুলোর ওপর সেই শহরের কার্বন নির্গমন এবং শক্তি খরচের পরিমাণ প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত নির্ভর করে। তাই এ বিষয়ে আমাদের সামনের দিকের পথচলার রূপরেখা কেমন হবে, সেটা এখন থেকেই না ভাবলে ভবিষ্যতে আমাদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।

লেখক: স্থপতি, শিক্ষক (স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) ও স্থাপত্য পরিবেশবিষয়ক গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাতক্ষীরায় ধান বোঝায় ট্রাক উলটে নিহত ২

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে কালের সাক্ষী ‘অভিশপ্ত নীলকুঠি’

দুপুর ১টার মধ্যে ৮০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

রিকশাচালকের পা ভেঙে দেওয়া সেই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার

ধানের বাম্পার ফলনের পরও হতাশ কৃষক

হোয়াটসঅ্যাপে প্রতারণা এড়াতে যা করবেন

বাঁশ-দড়ি বেয়ে মসজিদে যান ১১৫ বছর বয়সী অন্ধ মোয়াজ্জিন

আফগানিস্তানে বন্দুকধারীদের গুলিতে ৩ স্প্যানিশ পর্যটকসহ নিহত ৪

সৌদিতে বাংলাদেশি হজযাত্রীর মৃত্যু

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে স্নাতক পাসে চাকরি

১০

মেসির সেই ন্যাপকিন কত দামে বিক্রি?

১১

হাইকোর্টের আদেশ সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীর নামে থাকা স্কুলের নাম বহাল

১২

ব্র্যাক ব্যাংকে অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার পদে নিয়োগ

১৩

আজ ঢাকার যেসব এলাকায় গ্যাস কম থাকবে

১৪

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৫

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৬

চাঁদপুরে একদিনেই মারা গেলেন ৩ বীর মুক্তিযোদ্ধা

১৭

১৮ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৮

হামাসের সুড়ঙ্গ থেকে ৩ জিম্মির মরদেহ উদ্ধারের দাবি ইসরায়েলের

১৯

মিছিলে গিয়ে শ্রমিক লীগ নেতার মৃত্যু

২০
X