কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৪, ০৩:৩০ এএম
আপডেট : ২১ মে ২০২৪, ০৯:১২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নিমগ্নতার ব্যাকরণ মেডিটেশন

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

মানুষ যখন ভাবতে শুরু করে, তখন থেকেই আত্মনিমগ্ন হয়। মানুষ সচেতন বা অসচেতনভাবে নিমগ্ন হতে শেখে। এই নিমগ্নতাই সভ্যতা বিকাশের প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই নিমগ্নতার ব্যাকরণ শিক্ষা দেয় মেডিটেশন বা ধ্যান। মেডিটেশনের সূচনা এই উপমহাদেশে সাত হাজার বছর আগে। খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগের দেয়ালে মেডিটেশন বা ধ্যানরত মানুষের ছবি পাওয়া গিয়েছে এই অঞ্চলে। বাংলায় চর্চা হওয়া সব ধর্মেই ধ্যানের ব্যবহার দেখা দেয়, যা অন্য অঞ্চলে দেখা যায় না। ধ্যান এই অঞ্চলে শুধু ধর্মের অংশ নয়, সংস্কৃতিরও অংশ। এখানে লোকগীতিতেও গভীর ভাবনার বিষয়টি ফুটে ওঠে। লালন ফকির থেকে শাহ আবদুল করিম—সবার সৃষ্টিতেই গভীর ভাবনা বা ধ্যানের বিষয়টি ফুটে ওঠে। নদী, গাছপালা, পাহাড় সবই যেমন আমাদের এখানে প্রাকৃতিক, তেমনি ধ্যানও এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সহজাত। এটা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয়নি।

খ্রিষ্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগে বেদে ধ্যানের কথা বলা আছে। গভীর ভাবনার বিষয়টি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকলে প্রস্তুতি নিয়ে ধ্যান করা ব্যাপকভাবে এই অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি। বাংলাও এর বাইরে নয়। এ কারণে বৌদ্ধ ধর্মের ধারণ, শিক্ষা ও বিস্তারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাংলার মানুষ।

অষ্টম শতকে বাংলা থেকে যাওয়া মেডিটেশন পদ্ধতি চায়নায় চেন এবং জাপানে জেন নামে পরিচিত হয়। এ ধারার মেডিটেশন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। চায়নায় এ ধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া শিক্ষকদের অন্যতম দক্ষিণ ভারতের বোধিধর্মা। অষ্টম থেকে নবম শতকে তিব্বতিয়ান (টিবেটিয়ান) মেডিটেশনের নিয়মিত অনুশীলন শুরু হয়। একাদশ-দ্বাদশ শতকে মুসলমানদের মধ্যে মোরাকাবা বা ধ্যানের বিস্তার ঘটে প্রবলভাবে। বিশেষ করে সুফিরা এ বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন। বাংলায় আসা অসংখ্য সুফিসাধক বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি মোরাকাবা বিষয়টি তুলে ধরেন। সাধারণ পর্যায়ে তাদের কেউ কেউ খানকা প্রতিষ্ঠা করেন।

চৌদ্দ থেকে আঠারো শতকে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মধ্যে মেডিটেশন চর্চা শুরু হয়। তারা অফ্রিকায় মেডিটেশন করা তাদের পূর্বপুরুষদের ধারাকে আরও ডেভেলপ করে। উনিশ শতকে ভারতীয় আদি মেডিটেশনের ধারণা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকার ধর্মসভায় বক্তৃতা দিয়ে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেন।

বিশ শতকের মাঝামাঝি খ্রিষ্টীয় মেডিটেশনকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়। সাধক টমাস মেরটন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ফাদার টমাস কিটিং এ ধারাকে সামনে নিয়ে আসেন। সাধক সিনথিয়া বোরগেল্ট এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, যা নানাভাবে এখনো চর্চা করা হয়। ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় এর ব্যাপক প্রচার হয়। ১৯৫০-এর দশকে বৌদ্ধমন্দিরের বাইরে এসে ভারত ও বার্মায় বিপাসনা পদ্ধতিতে মেডিটেশন শেখানো শুরু করেন এস এন গোয়েনকা। ১৯৮১ সাল থেকে এ পদ্ধতি আন্তর্জাতিক রূপ নেয়। এ সময় ম্যাসাচুসেটস ও অস্ট্রেলিয়ায় এস এন গোয়েনকায় মেডিটেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৫০-এর দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মহাঋষি মহেশ যোগী তার ট্রান্সেনডেন্টাল মেডিটেশনকে জনপ্রিয় করে তোলেন, যা আমেরিকা, ইউরোপ, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে টিএম মেথড নামে বেশি পরিচিত। জনপ্রিয় পপ ব্যান্ড বিটলস মহেষ যোগীর ভক্ত হয়ে ওঠায় তা মেডিটেশন গ্ল্যামার যোগ হয়। ১৯৬০-এর দশকে ইসিজি ও ইইজি পরীক্ষার মাধ্যমে মেডিটেশনের কার্যকারিতা সম্পর্কে গবেষণা শুরু হয়। ভারতীয় ঋষি রামকে নিয়ে প্রথম আমেরিকান গবেষকরা মেডিটেশনের ওপর গবেষণা করেন। ১৯৭৫ সালে ইনসাইট মেডিটেশন সোসাইটি (আইএমএস) যাত্রা করে ম্যাসাচুসেটসে। থাই ধ্যান পদ্ধতির সঙ্গে পশ্চিমা মনস্তাত্ত্বিক উপস্থাপনার মাধ্যমে জোসেফ গোল্ডস্টেইন, শ্যারন সলজবার্গ, জ্যাক কর্নফিল্ড—তিনজন মিলে এ ধারার মেডিটেশনের প্রবর্তন করেন। ১৯৮৭ সালে দালাই লামা, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ফ্রান্সিসকো ভ্যারেলা, আইনজীবী ও উদ্যোক্তা অ্যাডাম এঙ্গল মিলে বিজ্ঞানভিত্তিক ও গবেষণামূলক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন মেডিটেশন মাইন্ড অ্যান্ড লাইফ ইনস্টিটিউট নামে। ১৯৯০-এর দশকে মাইন্ডফুলনেসের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে এর চর্চা দেখতে পাওয়া যায়। জন কাবাট জিনস পশ্চিমা দুনিয়ায় এই ধারাকে জনপ্রিয় করতে কাজ করেন। একবিংশ শতাব্দীতে মেডিটেশন একটি আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে। এর গ্রহণযোগ্যতা ও প্রসার ঘটে সর্বত্র। বাংলাদেশেও ১৯৯০-এর দশকের প্রথমভাগে ১৯৯৩ সালে শুরু হয় মেডিটেশন পদ্ধতি কোয়ান্টাম মেথডের যাত্রা। এই মেডিটেশন পদ্ধতি সহজ বাংলা ভাষায় এবং নাগরিক জীবনের উপযোগী করে উপস্থাপন করায় তা সহজেই মানুষের মনে জায়গা করে নেয়। আজ ২১ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। এ উপলক্ষে ঢাকায় প্রেস ক্লাবসহ সারা দেশে হচ্ছে নানা আয়োজন।

লেখক: সাংবাদিক ও অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ক্যাম্পাস থেকে ব্যানার-ফেস্টুন সরাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন

জেমকন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা কাজী শাহেদ আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার

আরও ৪ দেশে এনআইডি কার্যক্রমের অনুমতি

ব্রাজিল দলে জায়গা না পেয়ে নেইমারের রহস্যময় বার্তা

বদনজর ও কালো জাদুর ক্ষতি থেকে বাঁচার ৫ আমল

বিশ্বকাপজয়ী মেসিকে নিয়ে মিলল সুসংবাদ

চিকন শিশুকে মোটা বলায় সংঘর্ষ, আহত ১০

চিরকুট লিখে প্রাণ দিলেন ব্যবসায়ী

প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের দাবি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন

আফগানিস্তানে যাত্রীবাহী বাস উল্টে নিহত কমপক্ষে ২৫

১০

প্রধান শিক্ষক যুবলীগ নেতা, ফাঁদে পড়ে ইংরেজি শিক্ষক গরুর রাখাল

১১

প্রতীকী মূল্যে মসজিদ-মন্দিরকে জমি দিয়ে ইতিহাস গড়ল রেলওয়ে

১২

নওগাঁয় চালককে হত্যা, পাঁচজনের যাবজ্জীবন

১৩

শাহরুখ না, শাকিবকে নায়ক হিসেবে চান মনিকা

১৪

শেখ হাসিনাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান, ভূতের মুখে রাম নাম : অ্যাটর্নি জেনারেল

১৫

ত্রিদেশীয় সিরিজের জন্য দল ঘোষণা, ফিরেছেন জুনায়েদ সিদ্দিক

১৬

ভিকির মতো শান্ত মানুষ সাইকো থ্রিলার ভাবেন কীভাবে, প্রশ্ন নাবিলার

১৭

চন্দ্রনাথ পাহাড় ঘিরে উসকানিমূলক কিছু দেখামাত্র ব্যবস্থার নির্দেশ

১৮

আবুল খায়ের গ্রুপে মার্কেটিং অফিসার পদে নিয়োগ

১৯

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ, আজই আবেদন করুন

২০
X