পবিত্র মক্কা নগরী মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র এবং বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্মৃতিবিজড়িত জন্মভূমি। জন্মভূমি ও স্বদেশের প্রতি মানুষের আকর্ষণ স্বভাবজাত। মানুষ পৃথিবীর যে ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করে, সেখানকার আলো-বাতাস, প্রকৃতি-পরিবেশ ও মাটি-মানুষের প্রতি আত্মার টান অনুভব করে। জন্মভূমির প্রতি মানুষের এ স্বভাবজাত আকর্ষণকে ইসলাম সমর্থন করে। পবিত্র কোরআনেও স্বদেশপ্রেম সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। মহান আল্লাহ প্রত্যেক নবীকে একেকটি অঞ্চলে দ্বীনের দাওয়াতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। মুসা (আ.)-এর জাতি ও দেশ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন মুসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো, যখন তিনি তোমাদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছিলেন এবং তোমাদের রাজত্বের অধিকারী করেছিলেন। আর বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি প্রদান করেননি, তা তোমাদের দিয়েছেন।’ (সুরা মায়িদা : আয়াত ২০)। অনুরূপভাবে নুহ (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো নুহকে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের কাছে। সে বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়, আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ নেই। তবু কি তোমরা সাবধান হবে না।’ (সুরা মুমিন : ২৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি।’ (সুরা ইবরাহিম : ৪)।
কোরআনের এসব আয়াতে ‘কাওমিহি’ বা ‘স্বজাতি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর দ্বারা দেশ, দেশের মানুষ, দেশের ভাষা ও নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি সবিশেষ গুরুত্বের ইঙ্গিত করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে কাউকে নিজ দেশ ও মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করা ইসলামের চোখে খুব গর্হিত অপরাধ। তাই মক্কার কাফির কর্তৃক স্বদেশভূমি মক্কা থেকে রাসুল (সা.)-কে বিতাড়নের চেষ্টাকে কোরআনে ষড়যন্ত্র ও অন্যায় হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, কাফিররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দি করার জন্য, হত্যা অথবা নির্বাসিত করার জন্য। তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেন; আর আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।’ (সুরা আনফাল : ৩০)
জন্মভূমি ও স্বদেশের প্রতি রাসুল (সা.)-এর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। হিজরতের সময় পবিত্র মক্কা শরিফ থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘ভূখণ্ড হিসেবে তুমি কতই না উত্তম, আমার কাছে তুমি কতই না প্রিয়। যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিত, তবে কিছুতেই আমি অন্যত্র বসবাস করতাম না।’ (তিরমিজি : ৩৯২৬)। অন্য হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ বিন আদি বিন হারাম (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে খাজওয়ারা নামক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সেখানে তিনি বলেছেন, আল্লাহর শপথ! হে মক্কা, আল্লাহর জমিনে তুমিই শ্রেষ্ঠ; যদি তোমার কাছ থেকে আমাকে বের করে দেওয়া না হতো, তবে আমি তোমায় ছেড়ে অন্য কোথাও যেতাম না।’ (তিরমিজি : ৩৯২৫)
এ আবেগময় বেদনাকাতর অভিব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হিজরতের পর রাসুল (সা.) প্রায়ই মক্কায় ফিরে যেতে ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। আল্লাহ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘যিনি আপনার জন্য কোরআনকে জীবনবিধান বানিয়েছেন, তিনি আপনাকে অবশ্যই আপনার জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন।’ (সুরা কাসাস : ৮৫)। সাহাবিরাও নিজ দেশকে খুবই ভালোবাসতেন। হিজরতের পর মদিনায় আবু বকর (রা.) ও বেলাল (রা.) জ্বরাক্রান্ত হলেন, অসুস্থ অবস্থায় তাদের মনে স্বদেশভূমি মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠল। তখন তারা জন্মভূমি মক্কার দৃশ্যাবলি স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করেন।
প্রিয় জন্মভূমি মক্কা থেকে নবীজিকে হৃদয়বিদারক ঘটনার মাধ্যমে বের করে দেওয়ার দশ বছরের মাথায় বিজয়ী বেশে প্রবেশ করেন প্রিয় জন্মভূমিতে। নবীজিকে দেশান্তর করেই স্বজাতির দুষ্কৃতরা থেমে থাকেনি। মক্কা থেকে বের হয়ে যে মদিনায় হিজরত করেন, সেখানে বারবার হামলার মুখোমুখি হয়েছেন। নবীজি (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় যাওয়ার পর দ্বিতীয় হিজরিতে কোরাইশরা মদিনায় আক্রমণ করলে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে চরমভাবে পরাজিত হলেও পঞ্চম হিজরির ১৫ শাওয়াল শনিবার তারা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে এসে আবার মদিনায় আক্রমণ করে। সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ওহুদের যুদ্ধ।
প্রিয় জন্মভূমি মক্কা বিজয়ের পর দশম হিজরি সালে মহানবী (সা.) পবিত্র হজ পালন করেন। সেটাই ছিল তার জীবনের শেষ হজ, যা ইসলামের ইতিহাসে ‘বিদায়ী হজ’ নামে পরিচিত। বিদায় হজে লক্ষাধিক সাহাবির সামনে দশম হিজরির জিলহজ মাসের ৯ তারিখ বিকেলে আরাফাতের ময়দানে এবং পরদিন ১০ জিলহজ কোরবানির দিন বক্তব্য পেশ করেছিলেন। এ দুদিনে দেওয়া তার বক্তব্য বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে পরিচিত। নবী (সা.)-এর দৃঢ় আশঙ্কা ছিল যে, এটাই তার জীবনের সর্বশেষ হজ ও সর্বশেষ বিশ্ব সম্মেলন। জীবনের সর্বশেষ সম্মেলন হিসেবে তিনি ইসলাম ধর্মের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছেন এ ভাষণে। এটিই ছিল তার নবুয়তিজীবনের উপসংহার। ভাষণ শেষে ভাবের আতিশয্যে নবী (সা.) নীরব হন। জান্নাতি নুরে তার চেহারা আলোকদীপ্ত হয়ে ওঠে। এই মুহূর্তে নাজিল হয়—‘আজকের এই দিনে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকেই তোমাদের ওপর দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সুরা: মায়েদা, আয়াত: ৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ বিভিন্ন হাদিস, তাফসির, ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থে আংশিক এবং খণ্ড খণ্ড আকারে সংকলিত হয়েছে। বোখারি, মুসলিমসহ সব হাদিস গ্রন্থে বিদায় হজের ভাষণের উদ্ধৃতি অন্তর্ভুক্ত আছে। তবে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) সংকলিত ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে বিদায় হজের ভাষণসংক্রান্ত সর্বাধিকসংখ্যক উল্লেখ রয়েছে। মুসলিম শরিফের একটি বর্ণনা নিম্নরূপ—জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) লোকদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, তোমাদের রক্ত ও তোমাদের সম্পদ তোমাদের জন্য হারাম (মর্যাদাপূর্ণ) যেমন তা হারাম (মর্যাদাপূর্ণ) তোমাদের এ দিনে, তোমাদের এ মাসে এবং তোমাদের এ শহরে। সাবধান! জাহেলি যুগের সব ব্যাপার (অপসংস্কৃতি) আমার উভয় পায়ের নিচে। জাহেলি যুগের রক্তের দাবিও বাতিল হলো। আমি সর্বপ্রথম যে রক্তপণ বাতিল করছি, তা হলো আমাদের বংশের রবিআ ইবনু হারিসের পুত্রের রক্তপণ। সে শিশু অবস্থায় বানু সাদ এ দুগ্ধপোষ্য ছিল, তখন হুজাইল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করে। জাহেলি যুগের সুদও বাতিল হলো। আমি প্রথমে যে সুদ বাতিল করছি তা হলো আমাদের বংশের আব্বাস ইবনু আবদুল মুত্তালিবের সুদ। তার সব সুদ বাতিল হলো।
তোমরা স্ত্রী ও নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা তাদের আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কলেমার মাধ্যমে তাদের লজ্জাস্থান নিজেদের জন্য হালাল করেছ। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার এই যে, তারা যেন তোমাদের শয্যায় এমন কোনো লোককে স্থান না দেয় যাকে তোমরা অপছন্দ করো। যদি তারা এরূপ করে তাহলে হালকাভাবে প্রহার করো। আর তোমাদের ওপর তাদের ন্যায়সংগত ভরণপোষণের ও পোশাক-পরিচ্ছদের বিধান আছে। আমি তোমাদের মধ্যে এমন এক জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। ‘আমার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হলে তখন তোমরা কি বলবে?’ তারা বলল, ‘আমরা সাক্ষ্য দেব যে আপনি (আল্লাহর বাণী) পৌঁছিয়েছেন, আপনার হক আদায় করেছেন এবং সদুপদেশ দিয়েছেন।’ তারপর তিনি তর্জনী আকাশের দিকে তুলে লোকদের ইশারা করে বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো।’ তিনি তিনবার এরূপ বলেন। (মুসলিম, হাদিস : ৩০০৯)
বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্যায়ভাবে মানুষের রক্তপাত বন্ধ, সুদের কুফল, বর্ণবৈষম্যের ভয়াবহতা, স্বজনপ্রীতির বিরূপ প্রভাব, জাহেলি যুগের মানসিকতা পরিহার করার বিষয়ে জোরালো নির্দেশনা প্রদান করেছেন। নারীর অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের মর্যাদার বিষয় তুলে ধরেছেন। সাম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকের অধিকার রক্ষা, পরমতসহিষ্ণু হওয়া, সর্বোপরি মানবসভ্যতাবিরোধী সব বর্বরতা পরিহার করে একনিষ্ঠভাবে কোরআন-সুন্নাহ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। ভাষণে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে উম্মাহর ঐক্যের বিষয়টি। তিনি বলেন, হে লোকসকল! জেনে রেখো, তোমাদের রব একজন এবং তোমাদের পিতাও একজন। জেনে রেখো, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং আরবের ওপরও অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালোর ওপর সাদার এবং সাদার ওপর কালোরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র ভিত্তি তাকওয়া। আমি কি তোমাদের কাছে পৌঁছিয়েছি? উপস্থিত সাহাবারা বলেন, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল পৌঁছিয়েছেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩৪৮৯)। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ আমাদের শান্তি ও মানবতার শিক্ষা দেয়।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ