গত ১২ জুন (বুধবার) আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ২৬ জেলায় ১৮ হাজার ৫৬৬ পরিবারকে নতুন ঘর উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্য দিয়ে আরও ৭০টি উপজেলা ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ৫৮ জেলা এবং ৪৬৬ উপজেলা এখন ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত, যা দেশের জন্য অনেক বড় অর্জন।
অসহায় মানুষদের মধ্যে যখন প্রধানমন্ত্রী ঘর বিতরণ করছিলেন, তখন রাজধানীর পুরোনো ঢাকার বংশালের মিরনজিল্লা পল্লির হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাসের শেষ আশ্রয়টুকু রক্ষায় রাস্তায় আন্দোলন করছিলেন। এরই মধ্যে তাদের অনেকই উচ্ছেদ হয়ে আশ্রয় নেন খোলা আকাশের নিচে। কেউবা মন্দিরে গিয়ে রাত কাটান। অন্যদের চোখেমুখে তখন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা।
ভারতের কানপুর, নাগপুর ও এলাহাবাদ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকদের এ অঞ্চলে পরিচ্ছন্ন কাজের জন্য আনা হয়েছিল। তাদের কারও কারও ঠাঁই হয় ২৫ আগা সাদেক রোডে। এ পল্লি ঘিরে এখন সাত শতাধিক পরিবারের চার হাজারের বেশি মানুষের বসতি। তারা প্রত্যেকেই এ দেশের নাগরিক। সবার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা এই মিরনজিল্লা।
বসতি শুরুর পর ২৫ নম্বর এ কলোনি একটি দীর্ঘ ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। সময়ের কারণে মানুষ বেড়েছে। বেড়েছে পরিবারের সংখ্যা। এটাই নিয়ম। তাই এখানে একটি মন্দির-স্কুলও প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ কলোনিতে বহুতল ভবন নির্মাণ হবে। যেখানে থাকবে কাঁচাবাজার ও শপিং কমপ্লেক্স। অমানবিক এ সিদ্ধান্তের পালে হাওয়া জুগিয়েছেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তাকে সহযোগিতা করছেন একশ্রেণির সুবিধাভোগী মানুষ।
সিটি করপোরেশনের এ সিদ্ধান্তে ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন কলোনির সবাই। এটাই স্বাভাবিক। কোনোরকম পুনর্বাসন ছাড়াই ৪০০ বছরের পুরোনো বসতি থেকে কাউকে উচ্ছেদ করে দেওয়া পৃথিবীর কোনো আইন সমর্থন করে কি না, জানা নেই। তা ছাড়া মানবাধিকারের দৃষ্টিতেও তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যখন একটি মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলার লড়াই চলছে, তখন এরকম একটি সিদ্ধান্তকে নিন্দা জানানো ছাড়া আর কী করার আছে।
সিটি করপোরেশনের যুক্তি, কলোনির মাত্র ৬৬ জন বাসিন্দা পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়োজিত। বাদবাকি পরিবারগুলোর অনেকেই কর্মচ্যুত হয়েছে। কেউ মারা গেছে। কোনো না কোনো সময় সব পরিবারের কেউ না কেউ সিটি করপোরেশনের কর্মী ছিল। এখনো তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস পরিচ্ছন্ন কাজ। তাহলে কেন তাদের উচ্ছেদ করা হবে? এ সিদ্ধান্ত কোন আইনে যৌক্তিক? এর সঠিক ব্যাখ্যা এ অমানবিক কাজটি যারা করছেন, তাদের কাছেও হয়তো নেই। তবে করপোরেশনের মেয়রের মুখে শোনা গেছে, কলোনিতে অবৈধ বসতি আছে। দখলদার আছে। নানা অপকর্ম হয় এই কলোনি ঘিরে। মানলাম। নগর পিতার দাবি সঠিক। অপরাধ দমনে তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে, আইন আছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তার মানে তো তাদের উচ্ছেদ করে অনিশ্চিত জীবনের ঠেলে দেওয়া কোনো সমাধান হতে পারে না।
বসতি ঠেকাতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাস্তায় নেমেছেন। মেয়রের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। তবুও ৮০টি ঘর উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদ আতঙ্কে এরই মধ্যে লক্ষ্মী রানী, ভবন দাসের প্রাণ গেছে। সহায়-সম্বল হারানোর কষ্টে হাজারো মানুষের সামনে প্রকাশ্যে নিমগাছে রশিতে ঝুলে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান শাম্মী নামে এক হরিজন যুবক। তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একটি ভুল সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি প্রাণ গেল, এর দায় কে নেবে?
সমাজে পিছিয়ে থাকা মানুষদের অন্যতম এই হরিজনরা। তারা তো দেশের নাগরিক। তবে কেন পিছিয়ে থাকবে? সমাজে তাদের কি কোনো অবদান নেই? তারা না থাকলে এই নগরী কি পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব? সবাই যদি এক সপ্তাহ কাজ বন্ধ করে বসে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? এই ভাবনা কারও আছে। তারা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেও সমাজে এখনো অচ্ছুত। কেউ তাদের ভালো চোখে দেখে না। তুচ্ছ ভাষায় সম্বোধন করা হয়। তাদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। ভালো চাকরি দিতে চায় না। ব্যবসা করতে চাইলে এরও সুযোগ নেই। ভালো সমাজে মেশার ভাগ্য হয় না। নানা কারণে তারা সবাই একত্রে বসবাস করতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। উচ্ছেদ করে দেওয়া হলে তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
গত ১০ জুন এ পল্লিতে প্রথম উচ্ছেদ অভিযান হয়। সেদিন কলোনিজুড়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। অসহায় হরিজনদের প্রতি এত নির্দয় আচরণ কেন? এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকেই। কারও কারও বক্তব্য ছিল, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত ১৬ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। অথচ নাগরিক হয়ে হরিজনদের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এ ঘটনাকে নিষ্ঠুরতার কোন মানদণ্ডে সঞ্চায়িত করা যায়?
দ্বিতীয় দিন উচ্ছেদ আতঙ্কে কলোনির শিশুরা কেউ স্কুলে যায়নি। কোমলমতি শিশুদের সবাই স্কুলের পোশাক পরে মুখে কালো কাপড় বেঁধে হাতজোড় করে মিনতি জানাচ্ছিল, ‘আমাদের থাকা ও বাঁচার শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিও না। আমাদের থাকতে চাও। হাসতে চাও, বাঁচতে দাও।’ অনেকেই জীবনের মায়া না করে বুলডোজারের নিচে গিয়ে শুয়ে ছিল। বসতি রক্ষায় হাজারো শিশুর বুলডোজার ঠেকাতে রাস্তায় দিনভর শুয়ে থাকার দৃশ্য গণমাধ্যমের কল্যাণে গোটা বিশ্ব-বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এক কথায় বললে, শিশুরাই প্রতিবাদ করে দ্বিতীয় দিনের উচ্ছেদ ঠেকিয়েছে। কেউ কি ভেবেছে এ ঘটনায় শিশুদের মনে কী ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে?
এখানেই শেষ নয়, উপায় না পেয়ে কলোনির ভেতরে থাকা মন্দিরে গিয়ে দিনভর ঈশ্বরের কাছে কান্নারত অবস্থায় দুই হাত তুলে প্রার্থনা করেছেন অসহায় নারীরা। টানা ১২ ঘণ্টা নানা নাটকীয়তার পর রাতে পিছু হটেছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। সরিয়ে নেওয়া হয় পুলিশ। সবচেয়ে বড় যে অমানবিক কাজটি হয়েছে, তা হলো অভিযান শুরুর আগে কলোনির বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এটা কোনো ধরনের অমানবিকতা? পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল, হরিজনদের ওপর যেন শত শত বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, আক্রোশ আর প্রতিশোধ মেটানো হচ্ছে। তার মানে কি অসহায় হরিজনদের জন্য রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই?
পুরোনো ঢাকায় চলা অমানবিক এ খবরটি ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে চাপা থাকেনি। জাতীয় সংসদ পর্যন্ত উত্তাপ ছড়িয়েছে হরিজনদের সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি। তেমনি ৬০ জন বিশিষ্ট নাগরিক তাদের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। বাম নেতারাসহ বিরোধী দলের নেতারাও ঘটনাস্থলে গিয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবি, সুরক্ষা না দিয়ে তাদের উচ্ছেদ করা যাবে না। অর্থাৎ দেশ-বিদেশে এ ঘটনা কেন্দ্র করে তীব্র প্রতিবাদ চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ট্রল অব্যাহত আছে।
সর্বশেষ ১৩ জুন উচ্চ আদালত এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মিরনজিল্লা পল্লি উচ্ছেদে এক মাসের স্থিতাবস্থা জারি করে। তেমনি তাদের সবাইকে পুনর্বাসনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, সিদ্ধান্তটি যদি ন্যায়সংগত হতো তাহলে এরকম প্রতিবাদ হওয়ার কারণ ছিল? বা উচ্চ আদালতেই কেন হরিজনদের পক্ষ নেবে? এটা প্রমাণ করে না দক্ষিণের নগর পিতার সিদ্ধান্ত ভুল।
সংবিধানে তো নাগরিকের বাসস্থানসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা আছে। তাহলে তাদের বেলায় কি আলাদা কিছু। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারেও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘অনগ্রসর হরিজন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও তাদের বাসস্থানের মতো বিষয়ের উন্নতিতে সরকার অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করবে।’ বিষয়টি সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি। তা ছাড়া সরকার দেশকে ভূমিহীন ও গৃহহীন করতে চায়। এ তালিকা থেকে তাহলে হরিজনরা কেন বাদ যাবে? নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুল বুঝিতে তাদের প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখা হয়েছে।
শেষ কথা হলো, মিরনজিল্লা পল্লিতে ৩ দশমিক ২৭ একর জমি আছে। ২৭ শতাংশ জমিতে মার্কেট নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন আসে, সবাইকে উচ্ছেদ করতে হবে কেন। বাদবাকি জমিতে বড় ভবন নির্মাণ করে তাদের স্বাস্থ্যসম্মত বসতি নির্মাণ করে দেওয়া সম্ভব। সারা দেশে হরিজন সম্প্রদায়ের লোক আছে ১৬ হাজার। সমাজে পিছিয়ে থাকা দুর্বল জনগোষ্ঠী। একটু থাকার আশ্রয়ের জন্য তাদের নিয়ে কদিন পরপর কতরকম টানাহেঁচড়া হয়। সম্প্রতি ধলপুরে ১৪ আউটফল বস্তিতে পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়োজিত তেলেগুদের নিয়ে যেমন হয়েছে। এরপর কমলাপুরের টিটিপাড়ায় তেলেগু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে।
বাস্তবতা হলো, তারা কেউ ভালো নেই। সবকিছুতেই পেছনের সারিতে। গাদাগাদি বসবাসে তাদের মানবেতর জীবন, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তাদের থেকে নির্দয় দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়া হোক। সাধারণ ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মতোই তাদের স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করলে জয় হবে মানুষ ও মানবতার।
লেখক: সাংবাদিক