আফসান চৌধুরী
প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৩, ১২:০৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ধারাবাহিক

আফ্রিকার দিনরাত্রি

আফ্রিকার দিনরাত্রি

ইথিওপিয়ায় বিভিন্ন পক্ষের এ ক্ষমতা ভাগাভাগির মধ্যেই আবার উপ একটা দেশ আছে, যার নাম আমরা হয়তো মাঝেমধ্যে শুনে থাকব—সেটি হচ্ছে ইরিত্রিয়া। আমি যখন ইরিত্রিয়ায় গেছি, দেখি সেখানেও ইরিত্রিয়া লিবারেশন আর্মি বলে একটা গ্রুপ আছে। ওখানেও গৃহযুদ্ধ। সারাক্ষণ যুদ্ধ চলছে। আফ্রিকার প্রতিটি দেশেই তখন এরকম যুদ্ধ লেগেই আছে। আমি এ ব্যাপারে একবার একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন ও বলছে—দেখো, যুদ্ধ আমাদের থামবে না, কারণ আমরা তো জন্মেছিই যুদ্ধ করতে করতে; জীবনে এমন কোনো দিনের কথা মনে নেই যখন যুদ্ধ ছিল না। ওরা অনেকেই মাঝেমধ্যে বলত ওদের কথা যে, একটা যদি শক্ত রাজা থাকত ভালো হতো, আমাদের রাজতন্ত্রই ভালো ছিল। হাইলি সালাসে নামে ওদের একজন রাজা ছিল, তার আমলে যুদ্ধ কিছুটা কম ছিল। কিন্তু তারপর তো বিভিন্নভাবে যুদ্ধ হচ্ছে। অতএব আফ্রিকার এ বিচিত্র দুনিয়া সম্পর্কে আমরা কল্পনাও করতে পারব না। এ কষ্টগুলো আমরা ভাবতে পারব না, যা এ মানুষগুলো যাপন করে এবং মানুষগুলো তারপরও বেঁচে আছে। ইথিওপিয়ার আরেকটা বিশেষত্ব হচ্ছে, সারা দুনিয়ার মানুষ বলে এখান থেকেই নাকি মানবজাতির শুরু। আমি জানি না, কিংবা এটা এখন আর গবেষণায় প্রমাণ হবে না। তবে এটা ঠিক, ইথিওপিয়ায় যে মানুষগুলো আছে, আফ্রিকানদের মধ্যেও ওদের চেহারাটা আলাদা। ওদের নাক উঁচু, ওরা অত বিশাল বা লম্বাদেহী হয় না। আর নাইজেরিয়ান ও ইথিওপিয়ার মানুষদের কেউ যদি পাশাপাশি দেখে, তাহলে বুঝতে পারবে। নাইজেরিয়ায় যেমন প্রধানত দুটি যোদ্ধা জনগোষ্ঠীর মানুষ থাকে—একটি হচ্ছে উত্তর নাইজেরিয়াভিত্তিক হাউসা জনগোষ্ঠী। এরা মুসলমান; দেশের নেতৃস্থানীয়, দেখতে মোটাসোটা লম্বা তাগড়া। আরেকটা হচ্ছে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ইবো জনগোষ্ঠী। ইবোরা হলো নাইজেরিয়ান সিভিল ওয়ার বা বায়াফ্রা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিদ্রোহী। দেখতে কিছুটা চিকনা কিসিমের। উগান্ডাতেও একই, তারাও দিনের পর দিন যুদ্ধ করেছিল। মনে আছে একদিন উগান্ডার এক রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ একটা লোক গাড়ি থামিয়ে বলল—তুমি রাস্তায় হাঁটছ কেন! আসো গাড়িতে ওঠো। কোনো কারণ নেই, এমনিই। তাছাড়া তখন আমারও ভয়ডর কম লাগত। এখন অপরিচিত কেউ যদি রাস্তায় হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে বলে যে, এসো গাড়িতে—আমি কি উঠব? কিন্তু আফ্রিকায় তখন উঠেছিলাম। লোকটা আমাকে জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে এসেছ তুমি? বললাম, বাংলাদেশ। তারপর লোকটা বলল, চলো চা খাই। আমরা চা খেতে গেলাম। আস্তে আস্তে ওর পরিবারের কথা জানতে পারলাম। ওর এক ভাই মারা গেছে এইডসে। আরেক ভাই মারা গেছে যুদ্ধে। আমার কাছে মনে হতো আফ্রিকান দেশগুলোর প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ অপঘাতে মারা গেছে। আফ্রিকায় থাকার সময়টাতে এ চিত্রই আমার চোখের সামনে ছিল সারাক্ষণ, দিনের পর দিন। তবু মনে হয় সেখানে আমার বোধহয় শুধু নতুন দুনিয়াটাই দেখা হয়নি, দুনিয়ার অনেক ভালো মানুষের সঙ্গেও দেখা হয়েছে। এটাই হলো আমার আফ্রিকার স্মৃতি। সেই স্মৃতি বলতে আমি বেশ আগ্রহী, কারণ হয়তো পরে আর আমার বলার সুযোগ হবে না।

দুই. সাধারণত আমরা বাংলাদেশের মানুষরা আফ্রিকায় খুব একটা যাই না এবং তাদের সম্পর্কে আমাদের ধারণাও খুব একটা নেই। ১৯৯০ সালের দিকে আমাকে যখন অফিস থেকে বলা হলো যে, উগান্ডায় একটা কনফারেন্স হচ্ছে—আমাদের জাতিসংঘের কর্মীদের কনফারেন্স। মানে এইডসের মহামারিটাকে ভবিষ্যতে কীভাবে সামলানো যায়, সে ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা। তাদের একটা ধারণা ছিল যে, বাংলাদেশেও এইডস খুব প্রবলভাবে প্রবেশ করবে এবং এখানে সেটা ঠেকানোর মতো পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য কাঠামোও নেই। ভারতের ব্যাপারেও এ নিয়ে সন্দেহ ছিল। আর ভারতে এইডস আঘাত হানলে তা বাংলাদেশে স্বাভাবিকভাবেই প্রবেশ করতে পারে। আমি যেহেতু তখন তরুণদের নিয়ে কাজ করছিলাম, আমাকেও এ সম্মেলনের জন্য মনোনীত করা হলো। আমার মনে পড়ছে আফ্রিকায় যাওয়ার প্রস্তুতির দিনগুলোর কথা। বাড়িতে যদিও একটু দুশ্চিন্তা করছিল যে, আফ্রিকায় গিয়ে কীভাবে থাকব, আবার কোন বিপদে পড়ব না পড়ব ইত্যাদি। আমাকে বলা হলো ইয়েলো ফিভারের ভ্যাকসিন নিতে হবে। জানানো হলো এ ভ্যাকসিন বাংলাদেশে নেই। কারণ বাংলাদেশে তো ইয়েলো ফিভার নেই। কিন্তু যেহেতু জাতিসংঘের বিষয়, তারা কোথা থেকে যেন ভ্যাকসিন নিয়ে এলো আমার জন্য। আমি তো বেশ চিন্তিত! লোকজনের কাছে শুনলাম অনেক ব্যথা হতে পারে। যাই হোক, অবশেষে ইয়েলো ফিভারের ভ্যাকসিন নিলাম। আরও কয়েকটা ভ্যাকসিন নিতে হলো আমাকে। আমার যেহেতু এরই মধ্যে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে, তাই বিশেষভাবে ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্যও ইনজেকশন দেওয়া হতো নিয়মিত। এখন সেসব আর নেওয়া হয় না যদিও। এই ছিল আমার আফ্রিকা যাত্রার প্রস্তুতি পর্ব। তবে ভ্যাকসিনগুলো যে নিয়ে যাচ্ছি, এটা আমার জন্য একটা বড় ব্যাপার। দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে আমরা ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসে উঠলাম। আমরা মানে দুবাইতেই সঙ্গী হিসেবে পেলাম জাতিসংঘের আরেক বন্ধু পলকে। ও ফিলিপাইন ইউনিসেফে কাজ করে। জাতিসংঘের একটা নিয়ম ছিল যে, ফ্লাইট যদি ৯ ঘণ্টার বেশি হয়, তাহলে বিজনেস ক্লাস পাওয়া যায়। এ জন্য আফ্রিকায় যাওয়া-আসাটা আমার খুব ভালো লাগত। হাত-পা ছড়িয়ে বেশ আরাম করে ভ্রমণ করা যেত আরকি। তো দুবাই থেকে রওনা হলাম আমি আর পল। পলের সমস্যা হলো, ও নাকি ভ্যাকসিন নেয়নি। ও বলল, এ ভ্যাকসিন ফিলিপাইনে তো নেই-ই, এমনকি ফিলিপাইন ইউনিসেফ ভ্যাকসিন জোগাড়ও করতে পারেনি। এখন আমি টাকা নিয়ে এসেছি, ওখানে নেমে ভ্যাকসিন নিয়ে নেওয়ার একটা ব্যবস্থা করব। আমরা শুনেছি ওখানে নাকি ভ্যাকসিন না হলে ঢুকতেই দেয় না। আমরা ল্যান্ড করলাম উগান্ডার এনটেবে বিমানবন্দরে। এ বিমানবন্দরটা একটা কারণে বিখ্যাত ছিল—ইদি আমিনের সময় ইসরায়েলিরা এ বিমানবন্দরে হামলা করেছিল, যা অপারেশন এনটেবে নামে পরিচিত। যাই হোক আমি তো ভ্যাকসিন কার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি—এটাই যেন তখন আমার বিরাট একটা অর্জন। কার্ড দেখে আমাকে একটা কাগজ লিখে দিয়ে থ্যাংকইউ জানানো হলো। কিন্তু এখন পলের কী হবে! আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি। পল ওখানে গিয়ে বলল, আমি তো ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে পারিনি, এখানেই ভ্যাকসিন নিতে চাই। ওরা বলল, আচ্ছা তুমি ভ্যাকসিন নাওনি! তুমি কোথায় কাজ করো? পল বলল, জাতিসংঘের কথা। ওরা বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি ১৭ ডলার জমা দাও। পল ১৭ ডলার দিল। তারপর ওরা জানাল, ঠিক আছে তুমি চলে যাও, ভ্যাকসিন না দিলেও চলবে। তখন আমার চেহারাটা দেখার মতো। এইটা কোনো কথা হলো! আমি এত কষ্ট করে ভ্যাকসিনগুলো নিলাম আর ও কি না ১৭ ডলার জমা দিয়েই খালাস! কী আর করা, আমরা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। হোটেলটা ছিল লেক ভিক্টোরিয়ায়। মনে আছে, ভিক্টোরিয়া লেকের দারুণ মনোরম পরিবেশে সুন্দর একটা হোটেল ছিল সেটা। [পরের পর্ব এক সংখ্যা পর]

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

হুমকির মুখে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র ও জাতীয় গ্রিড লাইন

স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার পদত্যাগ

আজ ঢাকার আবহাওয়া যেমন থাকতে পারে

আড়ং ডেইরিতে নিয়োগ, দ্রুত আবেদন করুন

২৪ নভেম্বর : ইতিহাসের এই দিনে যা ঘটেছিল

নাশতায় যেসব খাবার নীরবে বাড়াচ্ছে আপনার রক্তচাপ

২৪ নভেম্বর : আজকের নামাজের সময়সূচি

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

বিয়ের সাজ নিতে গিয়ে দুর্ঘটনা, সিনেমা স্টাইলে হাসপাতালেই বিয়ে

১০

নতুন যুদ্ধ কৌশল ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’, এটা আসলে কী

১১

বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রেমিককে বিয়ে, সেই তরুণীর রহস্যজনক মৃত্যু

১২

টটেনহ্যামকে উড়িয়ে প্রিমিয়ার লিগে শীর্ষস্থান মজবুত করল আর্সেনাল

১৩

যে কারণে ক্ষমা চাইলেন বাফুফে সভাপতি

১৪

গাজায় সেনা পাঠানো নিয়ে নতুন সংকটে পাকিস্তান

১৫

তারেক রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে ৬১ ক্রিকেট ব্যাট-বল বিতরণ

১৬

ভূমিকম্পে আহত হামীমের চিকিৎসার খোঁজ নিলেন ডা. কাঁকন

১৭

৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা

১৮

খালেদা জিয়ার হাসপাতালে ভর্তির কারণ জানালেন চিকিৎসক

১৯

ফাইনালে সুপার ওভারে হেরে বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গ

২০
X