ফেসবুক তথা ইন্টারনেটের ওপর ভর করে দেশজুড়ে প্রায় ৫ লাখ এফ-কমার্স উদ্যোক্তা রয়েছেন। সঠিক হিসাব না থাকলেও ই-কমার্স সংশ্লিষ্টদের অনুমান, এই উদ্যোক্তাদের ৯০ শতাংশের বেশিই নারী। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে ইন্টারনেট এবং ফেসবুক বন্ধ থাকায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন এই নারী উদ্যোক্তারা। কারও স্টকে থাকা পণ্য বিক্রি হয়নি, কারও বাতিল হয়েছে আগের অর্ডার। কেউবা আবার বিপাকে পড়েছেন ফেসবুকে বিজ্ঞাপন চালিয়ে। একদিকে আয় তো বন্ধ, অন্যদিকে কর্মীদের বেতন পরিশোধ—সব মিলিয়ে ব্যাপক দুশ্চিন্তায় রয়েছেন নারী উদ্যোক্তারা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ২৮ জুলাই পর্যন্ত ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধ ছিল। এই ১০ দিনে এফ-কমার্স উদ্যোক্তাদের প্রায় ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থায় উদ্যোক্তাদের জন্য নীতিগত সহায়তা চেয়েছেন তারা।
গত ১৭ জুলাই সন্ধ্যা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফোর-জি মোবাইল ইন্টারনেট সীমিত করা হয়। ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় সঞ্চালন লাইনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বন্ধ হয়ে যায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। ফলে ইন্টারনেট সংযোগ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন উদ্যোক্তা এবং গ্রাহকরা। এ পরিস্থিতিতে বিকিকিনি বন্ধ হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েন এফ-কমার্স উদ্যোক্তারা। ২৩ জুলাই পরীক্ষামূলকভাবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং ২৮ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট চালু হলেও গত বুধবার দুপুর পর্যন্ত ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকায় বিপদেই ছিলেন এফ-কমার্স উদ্যোক্তারা।
উত্তরায় নিজের বাড়িতেই ‘রেনু’স ক্লোজিট’ নামে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে কাস্টমাইজড মসলিন শাড়ি ও পোশাক বিক্রি করেন জ্যোৎস্না আখতার। ইন্টারনেট এবং ফেসবুক বন্ধ থাকায় তার অনেকগুলো অর্ডার বাতিল হয়েছে। বিদেশি গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় হুমকিতে পড়েছে পাঁচ বছরে গড়ে তোলা ব্যবসার সুনাম।
এই নারী উদ্যোক্তা কালবেলাকে বলেন, গ্রাহকদের ফরমায়েশ অনুযায়ী কাস্টমাইজড করে পোশাক তৈরি করি। গত ২০ জুলাই পাঁচটি টু-পিস অস্ট্রেলিয়ায় ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। ইন্টারনেট বন্ধ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল থাকায় গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে পারিনি। ২৮ জুলাই বিয়ের দিন ধার্য ছিল আরেক গ্রাহকের, কিছু টাকা অগ্রিমও পরিশোধ করেছিলেন। তাকেও পোশাক দিতে পারিনি। ডেলিভারি করতে না পারায় স্টক হয়ে গেছে এগুলো। যেহেতু কাস্টমাইজড, তাই অন্য গ্রাহকের কাছে বিক্রিও করা যাবে না। এই ১০ দিনে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি সুনামও গেছে। ঘরে বসেই ব্যবসা করি। কারিগরসহ দুজন সহকর্মী আছে। তাদের তো পারিশ্রমিক দিতে হবে।
মিরপুর-২ নম্বর এলাকার গৃহিণী ফারজানা ইসলাম নিঝুম ‘ফারজানাস কর্নার’ নামে ফেসবুক পেজে নারীদের পোশাক বিক্রি করেন। ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধ থাকায় থমকে ছিল তার ব্যবসা। ফারজানা বলেন, এই পেজের আয় দিয়েই আমার সংসার চলে। আমার একজন সহকর্মীও রয়েছেন। আমার সংসার না চললেও তাকে তো বেতন দিতে হবে। এখন ফেসবুক চালু হয়েছে, দেখা যাক কী হয়। ‘টাইম পাস’ নামে রাজধানীর খিলগাঁও থেকে ক্লাউড কিচেন পরিচালনা করেন নারী উদ্যোক্তা সুমাইয়া ইসলাম। নিজের ফেসবুক পেজ থেকে খাবারের অর্ডার নিয়ে ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছান সেসব খাবার। তবে ইন্টারনেট এবং ফেসবুক বন্ধ থাকায় থমকে আছে ‘টাইম পাস’-এর কার্যক্রম।
সুমাইয়া কালবেলাকে বলেন, কাঁচা মাছ, মাংস কেনা ছিল। গ্রাহকদের তাজা ও ফ্রেশ খাবার রান্না করে ডেলিভারি করি। কিন্তু ইন্টারনেট এবং ফেসবুক না থাকায় সব বন্ধ হয়ে যায়। এই খাবার বিক্রির টাকা দিয়েই আমার সংসার চলে। মাসখানেক হলো শুরু করেছিলাম। সব শেষের পথে।
নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা দেশের শীর্ষ প্ল্যাটফর্ম ‘উই’-এর প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা কালবেলাকে বলেন, এমন অনেক নারী এফ-কমার্স উদ্যোক্তা আছেন, যাদের একদিনের বিক্রি দিয়ে পরের দিন চলে। স্টকে থাকা পণ্য বিক্রি করে আবার স্টক করেন তারা। এদের বেশিরভাগই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। শুধু ঢাকা নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমনসব উদ্যোক্তা আছেন,Ñযারা এই পরিস্থিতিতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। যে ক্ষতি হলো, তাতে অনেকে হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। যারা পারবেন তাদের অন্তত ৬ মাস সময় লাগবে।
এদিকে ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার এফ-কমার্স উদ্যোক্তাদের ফেসবুক নির্ভরতা কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, একটা অবস্থা তো আমরা সবাই দেখলাম। ফেসবুকের বিকল্প ভাবতে হবে। ফেসবুকের নিজেরও বিভিন্ন সময় সমস্যা হয়। হুট করে অনেক দিনের পুরোনো পেজ বা গ্রুপ বন্ধ হয়ে যায়। তাই ব্যবসার স্থায়িত্বে নিজেদের আত্মনির্ভরশীল কিছু একটা গড়ে তুলতে হবে।