ছাত্র আন্দোলনের মুখে টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কৌশলী অবস্থান নিয়েছে বিলুপ্ত সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন জানিয়ে সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। সামনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে জাপা আওয়ামী লীগ না বিএনপিকে সমর্থন দেবে, তা চূড়ান্ত করবে। এজন্য তিন মাস সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে দলটি। এই সুযোগে দল চাঙ্গা করতে চান শীর্ষ নেতারা।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতায় জয়ী হওয়া ১১ সংসদ সদস্যের মধ্যে অন্তত আটজন আতঙ্কে আছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনরোষ থেকে বাঁচতে দলটির নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সদ্য সাবেক সংসদ সদস্যরাও আত্মগোপনে রয়েছেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার জাপার জরুরি প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে সদ্য সাবেক ১১ সংসদ সদস্যের সবাই উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে তাদের আতঙ্কে থাকার বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় দলের পক্ষ থেকে সবাইকে সতর্ক হয়ে চলারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
জাপার সদ্য সাবেক চারজন এমপি কালবেলাকে বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আমাদের মধ্যে আতঙ্ক হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ায় আস্তে আস্তে ভয় কেটে যাচ্ছে। তবে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণে একাধিক সংসদ সদস্য ঢাকার নিজ বাসায় থাকছেন না। গ্রামেও যাচ্ছেন না।
সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধতে দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের চাপ ছিল জাপার শীর্ষ নেতাদের প্রতি। কিন্তু সমঝোতার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দলপ্রধান থেকে শুরু করে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হন। নির্বাচনে অংশ নেওয়াকে কেন্দ্র করে রওশনের নেতৃত্বে জাপায় এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ ভাঙন হয়েছে। এর রেশ ছিল বুধবারের প্রেসিডিয়ামের বৈঠকেও। সেখানে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা দলের রাজনৈতিক বেশকিছু সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন, এমনকি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের কাছে জবাব চান।
জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্য এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার কালবেলাকে বলেন, দলের সদ্য সাবেক এমপিদের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ নেই। তাই আমাদের এত ভয়ের কিছু নেই। আমরা মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলাম, আছি, থাকব। মানুষের জন্য রাজনীতি করি। এলাকায় কাজ করেছি। এমপি না থাকলেও সবাই কাজ করবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এলাকায় যাওয়া হচ্ছে না। দ্রুতই এলাকায় যাওয়ার কথা জানান তিনি।
বুধবারের প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে মূলত চারটি বিষয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এগুলো হলো দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা, বিগত নির্বাচনে অংশ নেওয়া, ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপির প্রতি সমর্থন দেবে এবং বর্তমান সরকারের প্রতি দলের অবস্থান। বৈঠকে অংশ নেওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য ছাড়া বেশিরভাগ নেতাই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা করেন। তারা এ বিষয়ে চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
জবাবে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। মূলত বাধ্য হয়ে নির্বাচনে গিয়েছেন বলেও বৈঠকে উল্লেখ করেন তিনি।
জাপার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান প্রসঙ্গে বৈঠকে জি এম কাদের জানান, আপাতত বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কোনো দলের রাজনৈতিক মিত্র হতে চান না তারা। অন্তত আগামী তিন মাস পর পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করতে চায় দলটি। বৈঠকে কেউ কেউ আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে পরামর্শ দেন। সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রসঙ্গে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, এখন জাপার ওপর কোনো চাপ নেই। বাধাও নেই। তাই দল গোছানোর উপযুক্ত সময় এখন। আমাদের সবাইকে মাঠে নেমে দল গোছাতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে কাজে নামার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, আগামী নির্বাচনের আগে আমরা দলকে সারা দেশে শক্তিশালী করতে পারলে ফল ভালো হবে।
জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু কালবেলাকে বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক দল পরিচালনা করতে হয়। আমরা সেই ধারা থেকে বিচ্যুত হইনি। জাতীয় পার্টি একটি নির্বাচনমুখী দল। আগামী সংসদ নির্বাচনে আমরা অংশ নেব। তখন কাদের সঙ্গে থাকব, তা সময়ই বলে দেবে।