ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন থেকে সরে এসে বিগত সরকারের আমলে এই শিক্ষাক্রমের ওপর প্রণীত বইয়ের দরপত্রও বাতিল করা হয়। পুরোনা শিক্ষাক্রমের ওপর প্রণীত বইগুলো পরিমার্জন করে আগামী বছর শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই অনুযায়ী, বিনামূল্যের পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ প্রায় শেষ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এরই মধ্যে প্রাথমিকের কয়েকটি শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার কাজও শুরু হয়েছে। এনসিটিবির আশা, ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রাথমিকের সব বই ছাপার কাজ শেষ হবে।
তবে মাধ্যমিকের বই নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার। একদিকে বই ছাপার দরপত্র বাতিল হয়েছে, অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এনসিটিবির হাতে সময়ও কম। এতে সংশোধনের কাজে দেরি, নতুন কনটেন্ট যুক্ত হওয়া, বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহারের জন্য গ্রাফিতি নির্বাচনসহ বিভিন্ন কারণে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মাধ্যমিকের সব বই ছাপার কাজ শেষ হচ্ছে না। তবে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীরা যাতে অন্তত কিছু বই হাতে পায়, সেই চেষ্টাই করছে এনসিটিবি। সেজন্য তারা ষষ্ঠ থেকে দশম পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণিতে পাঁচটি বিষয়ের বই ছাপার কাজ ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চাচ্ছে। বিষয়গুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়। এর মধ্যে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির সব বই ডিসেম্বরের মধ্যে ছাপার কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করেছে এনসিটিবি। তবে নবম ও দশম শ্রেণির সব বই আগামী বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা তাদের। যদিও ছাপাখানাগুলোর মালিকরা বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে মাধ্যমিকের পাঁচটি বই হাতে পাওয়া কষ্টকর হবে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বইয়ের চুক্তি ও কার্যাদেশে দেরি করছে এনসিটিবি।
এনসিটিবি থেকে জানা গেছে, ২০২৩ সালে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর পর চলতি বছরও এই শিক্ষাক্রমের ওপর প্রণীত বই গেছে শিক্ষার্থীদের হাতে। এই শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা কমে গিয়েছিল। কিন্তু পুরোনো শিক্ষাক্রমে বইয়ের সংখ্যা ছিল বেশি। সে কারণে আগামী বছর বইয়ের সংখ্যাও বেড়ে যাবে। আগামী বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২২টি, সপ্তম শ্রেণিতে ২১টি, অষ্টম শ্রেণিতে ২০টি এবং নবম ও দশম শ্রেণিতে ৩৩টি করে বই পাবে শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বইয়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কম সময়ে বই ছাপার কাজ শুরু করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে এনসিটিবি।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৯৬৪ লটে ছাপা হবে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। এর মধ্যে প্রাথমিকের ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫ কপি বই। অন্যদিকে মাধ্যমিকের ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই।
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী গতকাল রোববার থেকে প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজ শুরু করেছে ছাপাখানাগুলো। গত ৭ অক্টোবর প্রাক-প্রাথমিক এবং চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র হয়েছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র হয়েছে ২০ ও ২১ অক্টোবর। অষ্টম শ্রেণির দরপত্র শেষে এখন মূল্যায়নের কাজ চলছে। তবে নবম ও দশম শ্রেণির বইয়ের এখনো দরপত্র হয়নি। দরপত্র শেষে কয়েকটি ধাপ পার হয়ে জানুয়ারিতেও মাধ্যমিকের কাজ শেষ হবে না।
একজন ছাপাখানা মালিক কালবেলাকে বলেন, এখনো নবম ও দশম শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার হয়নি। অষ্টম শ্রেণির বইয়ের মূল্যায়ন শেষ হয়নি। টেন্ডারের পর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই কোথায় আছে, ছাপাখানাগুলো জানে না। বছরের শেষদিকে এসে এনসিটিবি হয়তো ছাপাখানা থেকে কাজ আদায়ে কড়াকড়ি করতে পারে, কিন্তু দেরিতে চুক্তি করে যথাসময়ে বই পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ কালবেলাকে বলেন, এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বই ছাপানোর কাজ শুরু হয়েছে। সে কারণে আমরা কয়েক মাস আগে থেকেই এনসিটিবির সংশ্লিষ্টদের বলে আসছি, নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ের বই আগে আগে ছাপানোর ব্যবস্থা করতে। এরপর ধাপে ধাপে বাকি বইগুলো ছাপানো হলে খুব বেশি চাপ পড়বে না। এনসিটিবি দেরিতে হলেও বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান কালবেলাকে বলেন, সংশোধন শেষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বেশিরভাগ বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে গেছে। কাভারে গ্রাফিতি স্থাপনের কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ ডিসেম্বরের প্রথমার্ধেই শেষ হয়ে যাবে। তবে মাধ্যমিকের সব কাজ শেষ করতে কিছুটা সময় লাগবে। আমরা ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে মাধ্যমিকের ৫-৬টি বই এবং বাকি ১০ দিনের মধ্যে অন্য বইগুলো দিতে চাচ্ছি। প্রেসগুলোর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই সব বই দিতে পারব বলে আশা করছি।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, টার্গেট করে শুরুতে পাঁচটি বই দেওয়া এবং বাকিগুলো পরে দেওয়া হলে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীরা বইও পাবে আবার এনসিটিবির ওপর চাপও পড়বে না। তবে বইয়ে যাতে ভুল না থাকে, সেজন্য এনসিটিবি ও ছাপাখানাগুলোকে যৌক্তিক সময় দিতে হবে। এ ছাড়া ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই দিতে না পারলেও পাণ্ডুলিপি লাইভ রাখতে হবে ওয়েবসাইটে।