চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ নৌপথে বহুল প্রতীক্ষিত ফেরি সার্ভিসের উদ্বোধন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ফেরির যুগে প্রবেশ করল চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। একই সঙ্গে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সমুদ্রপথে ফেরি চলাচলের সূচনা হলো। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৮টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ঘাটে পাঁচজন উপদেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে এই ফেরি সেবার উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
উদ্বোধনের পর সকাল ৯টায় উপদেষ্টাদের নিয়ে ফেরি সন্দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা করে। ৫৫ মিনিট পর ১০টা ৫৫-তে ফেরিটি সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে পৌঁছায়। পরে উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘সন্দ্বীপ বাংলাদেশের অন্যতম উপকূলীয় দ্বীপ। কিন্তু স্বাধীনতার পর ঐতিহ্যবাহী এ জনপদের সঙ্গে দেশের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। কী লজ্জাকর, ৫০ বছর পার হয়ে গেল! একদিকে বিরাট শহর ও বন্দর সবকিছু চলছে, অন্যদিকে এখানে আসতে ও নিজের বাড়িতে যাওয়ার সময় মধ্যযুগীয় অবস্থায় আমাদের চলে যেতে হয়। এটা আমরা সহ্য করে যাচ্ছি, এটা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য হচ্ছে না। আজ আমরা সে কলঙ্ক থেকে মুক্ত হলাম।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘এটা মাত্র শুরু হলো। এটা আরও সুন্দর ও নিরাপদ হবে। সন্দ্বীপ যাওয়ার কথা শুনলে মানুষ যেন ভয় না করে, যাওয়ার সময় যেন মানুষ মনে না করে—কী বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। এখন সন্দ্বীপে শুধু নিজেরা যাব না, বন্ধু-বান্ধব, বিদেশ থেকে যারা আসবে সবাইকে নিয়ে সেখানে যাব। ফুর্তি করব। রিসোর্ট হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, ‘সন্দ্বীপের লোক সারা আমেরিকাজুড়ে আছে। নিউইয়র্ক শহর তো তারা বন্দি করে রেখেছে। ওখান থেকে কেউ এলে অন্যজন বলত কোথায় যাচ্ছিস, সাবধানে থাকিস। এ রকম যেন আর না হয়। এখন তারা ওখানের বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আসবে, তাদের দেখাবে আমাদের বাড়ি কোথায়, দেশ কোথায়। বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে, চট্টগ্রাম শহরে যা পাওয়া যায় না, সন্দ্বীপে তা পাওয়া যায়। আপনাদের সে সুযোগ আছে। আপনারা যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান, সেটার একটি ক্ষুদ্র অংশও সন্দ্বীপের উন্নয়নের জন্য খরচ করা হলে আপনারা অনেক এগিয়ে যাবেন। আপনাদের যাতায়াতের সুযোগটা করে দিলে সব কিছু হয়ে যেতে পারত।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম; প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
উচ্ছ্বসিত দ্বীপবাসী: সন্দ্বীপে প্রায় চার লাখ মানুষের বাস। নানা কাজে এ জনপদের বাসিন্দাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া করতে হয়। চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূল ও সন্দ্বীপের মাঝে রয়েছে উত্তাল নৌ-চ্যানেল, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭ কিলোমিটার। এ পথ পাড়ি দিতে শিশু, নারী ও বয়োবৃদ্ধ যাত্রীদের নৌযাত্রায় প্রতিনিয়ত অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কখনো এক বুক, কখনো বা এক কোমর পানি, আবার কখনো এক হাঁটু পরিমাণ কাঁদা মাড়িয়ে কূলে উঠতে হয়। সূর্য ডোবার পর বন্ধ হয়ে যায় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দিনের পর দিন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে হয় দ্বীপের বাসিন্দাদের। এসব বিবেচনায় ২০২২ সালে সন্দ্বীপে ফেরি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে ফেরি চালু হওয়ায় ব্যাপক উচ্ছ্বসিত দ্বীপের মানুষ। ফেরি উদ্বোধন উপলক্ষে গতকাল ঘাটের দুপাশে শত শত লোক উপস্থিত হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
মীর মাকসুদ নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি আমাদের দ্বীপে সরাসরি গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু এখন এটা স্বপ্ন নয়, গাড়ি নিয়ে আমরা সন্দ্বীপ চলে যাচ্ছি। সারা বছর যেন যেতে পারি, কর্তৃপক্ষ যেন সে ব্যবস্থা করে।’
ফেরির স্বপ্ন যেভাবে সত্যি হলো: ২০২০ সালে তৎকালীন সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান ফেরি সার্ভিস চালুর জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ ফেরি সার্ভিস চালুর জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রাক্কলন নির্ধারণ করতে বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে বর্তমান পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর ওই কমিটি সম্ভাব্য তিনটি নৌপথ পরিদর্শন করে ফেরি চলাচলের জন্য গাছুয়া আমির মোহাম্মদঘাট (সন্দ্বীপ)-বাঁকখালী (সীতাকুণ্ড) রুট চূড়ান্ত করে। সে সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০২৩ সালের মার্চে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে বেড়িবাঁধ থেকে সন্দ্বীপ চ্যানেলের দিকে ২ কিলোমিটার সড়কও নির্মাণ করে। ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা সন্দ্বীপের বাসিন্দা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান উদ্যোগী হয়ে ফেরিঘাট নির্মাণ কার্যক্রম হাতে নেন।
বর্ষায় চলবে কি না, আছে শঙ্কা: বর্ষা মৌসুমে যাতায়াতে সন্দ্বীপবাসীকে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর এসময়ে উত্তাল সাগরে ফেরি চলাচল করতে পারবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, মার্চ মাসের পর থেকেই ধীরে ধীরে সন্দ্বীপ চ্যানেল অশান্ত হয়ে ওঠে। এই চ্যানেলে জোয়ার-ভাটায় পানির স্তরের
হ্রাস-বৃদ্ধির পার্থক্যও অত্যধিক হয়। এ তারতম্যের কারণে এ চ্যানেলে ফেরি চালানো কঠিন হবে।
বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ রুটে যে ফেরি চলছে তা এ অঞ্চলে চলাচলের উপযোগী নয়, তাই এপ্রিল থেকে হয়তো ফেরি চলাচল বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু বিআইডব্লিউটিসি উপকূলীয় এলাকায় চলাচল উপযোগী ফেরি নির্মাণ করছে। আগামী বছর থেকে এই সমস্যা আর থাকবে না বলে আশা করা যায়।
মন্তব্য করুন