বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতি বছর পালিত হয় মে দিবস। দিবসটি কেন্দ্র করে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে; কিন্তু সময়ের আবর্তনে তা আবার মিইয়ে যায়। শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা, কর্মীবান্ধব কর্মস্থল ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে আইনি সুরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ের সেই পুরোনো দাবি ঘুরেফিরে উঠছে এবারের মে দিবসেও। অন্যবারের চেয়ে এবার শ্রমিকের মনে দেখা দিয়েছে নতুন আশার আলো। এ জন্য শ্রমিকরা তাকিয়ে আছেন শ্রম সংস্কার কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদনের দিকে, যা বাস্তবায়িত হলে শ্রম অবহেলা দূরীভূত হয়ে শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত হবে।
তবে শ্রমিক নেতা ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো আশাজাগানিয়া, এর বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ। এ জাতীয় সুপারিশ বিগত সরকারগুলোর সময় ওঠে এসেছে; কিন্তু ক্ষমতাসীনরা পরে ভুলে যান শ্রমিকের অধিকারের কথা।
শ্রম সংস্কার কমিশন গত ২১ এপ্রিল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে একটি প্রতিবেদন জমা দেয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। প্রতিবেদনে শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা, স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠনসহ কর্মক্ষেত্রে তুই-তুমি সম্বোধন বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া শ্রমিকদের জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, শ্রমিকদের নিবন্ধন থেকে শুরু করে পরিচয়পত্র দেওয়া, শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত এবং তাদের দর-কষাকষি করার প্রক্রিয়া যেন আরও সহজ হয়, তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি দূর করতে নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করাসহ শ্রমিকদের কল্যাণে সর্বজনীন তহবিল করার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার কালবেলাকে বলেন, শ্রমিকের জান, জবান ও জীবিকার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কমিশনের হয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। অভ্যুত্থান-পরবর্তী এই সংস্কার কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করেছে। এখানে ন্যূনতম মজুরির মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছি, ফলে জাতীয় মজুরি কমিশন খাতওয়ারি বেতন নির্ধারণ করবে। যাতে নিয়মিত হয় সে জন্য তিন বছর পর পর জাতীয় ন্যূনতম মজুরির সুপারিশ করা হয়েছে। শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ করা হয়েছে বলে জানান তাসলিমা আখতার।
এদিকে প্রায়ই দেশে বিভিন্ন বিষয়ে শ্রমিক বিক্ষোভ তৈরি হয়। শ্রমিকের অধিকার, আইনি সুরক্ষার দাবিতে আন্দোলনে নামেন শ্রমিকরা। ন্যূনতম মজুরি, বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে ফুঁসে ওঠেন শ্রমিকরা। এসব বিষয় থেকে চিরমুক্তির জন্য শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা।
এ বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যেসব দাবি সামনে এসেছে, তার প্রায় সবই এই কমিশনের সুপারিশে উপস্থিত। তবে তা বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর শ্রমিকের কল্যাণে এমন অনেক দাবিই ছিল; কিন্তু পরবর্তী সরকার সেসব বাস্তবায়ন করেনি। তিনি বলেন, দলীয় সরকারের সঙ্গে এই সরকারের চরিত্র আলাদা কিছু নয়। এ জন্য শঙ্কা রয়েছে সংস্কার বাস্তবায়ন হবে কি না। এই প্রতিবেদনে ন্যূনতম মজুরি নির্দিষ্টকরণ করা হয়নি। মহার্ঘ ভাতা নিয়ে আলোচনা হয়নি। কারখানায় কর্মরত শ্রমিক মারা গেলে প্রদেয় অর্থ বৃদ্ধির বিষয় গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল।
অন্যদিকে, শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে গৃহ ও কৃষি শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তি ও তাদের স্বীকৃতির প্রস্তাব বিশাল জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে গৃহকর্মের সঙ্গে জড়িতদের মৃত্যুতে যে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার বঞ্চিত ছিল, তা ছিল শ্রমিকদের মনোবেদনার কারণ। কিন্তু এই শ্রমিকদের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আইন সংশোধন করার প্রস্তাব প্রতিবেদনে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা।
এ বিষয়ে জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুর্শিদা আখতার নাহার কালবেলাকে বলেন, প্রতিবেদনটি আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে গৃহ শ্রমিকদের জন্য। ২০১১ সালের আইএলও সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি। কারণ ২০০৬ সালের আইনে গৃহ ও কৃষি শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আইনটি সংশোধন করে শ্রমিকদের স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও গৃহ শ্রমিক নির্যাতিত হয়, হত্যার শিকার হয়। অথচ তারা ন্যায় বিচার পায় না। এখন সেই পথ খুলে গেল।
মন্তব্য করুন