পাহাড়ি ঢলের তোড়ে হঠাৎ বন্যায় ভেসে যায় দেশের যেসব এলাকা তার মধ্য অন্যতম সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট। প্রতি বছরই পানির তোড়ে ভেসে যায় শত শত বাড়িঘর, গবাদি পশু-পাখি, নষ্ট হয় ক্ষেতের বিপুল ফসল। মানুষের প্রাণহানির সংখ্যাও কম নয়। ২০২২ সালের প্রলয়ংকরী আকস্মিক বন্যার দগদগে ক্ষতচিহ্ন এখনো ভুলতে পারেনি এ অঞ্চলের মানুষ। বছরে একাধিক বন্যা মোকাবিলা করেই জীবন অতিবাহিত করা যেন এক ধরনের প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য গত দুই বছর ধরে আগাম বার্তা পেয়ে বন্যা মোকাবিলার পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করছেন গোয়াইনঘাটের বাসিন্দারা। এতে করে আগের তুলনায় বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাচ্ছেন উপজেলাবাসী। আর তা সম্ভব হয়েছে ২০২৩ সাল থেকে চলমান সুফল প্রকল্পের বদৌলতে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আকস্মিক বন্যাপ্রবণ সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের নিয়ে কাজ করছে সুফল প্রকল্প। কেয়ার বাংলাদেশ, কনসার্নসহ কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থার কনসোর্টিয়াম উদ্যোগ সুফল (স্কেলিং-আপ ফোরকাস্ট-বেইজড অ্যাকশন অ্যান্ড লার্নিং ইন বাংলাদেশ) প্রকল্প, যা স্থানীয়ভাবে বাস্তবায়ন করছে উন্নয়ন সংস্থা এফআইভিডিবি। মূলত আগাম বার্তা, আগাম প্রস্তুতি ও আগাম অর্থায়ন নিয়ে কাজ করা হয় এ প্রকল্পের মাধ্যমে।
উপজেলাটির রুস্তমপুর ও লেঙ্গুরা ইউনিয়নে বসবাস অর্ধলক্ষাধিক মানুষের। এর মধ্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষের মোবাইল ফোন নম্বরে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান রাইমসের পক্ষ থেকে পাঠানো হয় বন্যা, বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা (ভয়েস মেসেজ)। যে তথ্য সমাজের অন্যদের জানিয়ে দেন তারা। ফলে সবাই দুর্যোগ মোকাবিলার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন, থাকেন সতর্ক। শুধু তাই নয়, আগাম প্রস্তুতির অংশ হিসেবে অতিদরিদ্রদের দেওয়া হয় আর্থিক সহায়তা। এতে করে গত দুই বছরে এ এলাকায় বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যেমন কমেছে, তেমনি কমছে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা।
সুফল প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের একজন লেঙ্গুরা ইউনিয়নের হাসিনা বেগম। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘২০২২ সালের বন্যায় আমার ঘরবাড়ি সব ডুবে যায়। পানি আসার খবর যখন পেয়েছি, তখন কিছুই করার ছিল না। তিনটা ছাগলের একটা ডুবে মরে যায়, ২৫ থেকে ৩০টি ডিমপাড়া হাঁস ভেসে যায়। এখন সুফল প্রকল্পের কারণে বৃষ্টি, বন্যা ও বজ্রপাতের অগ্রিম বার্তা পাই। প্রকল্প শেষ হলে কিছু সমস্যা হবে, তবে যে শিক্ষা পেয়েছি তা খুব কাজে আসবে।’
একই গ্রামের রাজিয়া বেগম জানান, বন্যার পানির আগাম তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজার থেকে শুকনা খাবার কেনা ও বিশুদ্ধ পানি মজুত এবং শিশু, বয়স্ক ও অন্তঃসত্ত্বাদের আশ্রয়কেন্দ্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পৌঁছে দেয়। এ ছাড়া প্রয়োজনে ক্ষেতের ফসল তুলে নিয়ে আসা এবং গবাদি পশু নিরাপদে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করে।
২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় এ এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিয়ে সজনা বেগম বলেন, ‘আগাম বার্তা ও প্রস্তুতির কারণে ২০২৩ সালের পরের বন্যাগুলোয় ক্ষতি কম হয়েছে। যদিও পাহাড়ি ঢলে মুহূর্তেই রাস্তা-ঘাট ডুবে যায়, তখন নৌকায় করে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়। আবার অনেকের কাছে জমানো অর্থ থাকে না, এমন সময় অর্থ জোগাড় করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিপদের ওই সময়ে সুফল প্রকল্পের দেওয়া আর্থিক সাহায্য আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে, যা দিয়ে খাবার কেনা ও নৌকার ভাড়া দিয়ে দুর্যোগ পার করা যায়।’
সুফলভোগী সুলতানা বেগম বলেন, এলাকার হতদরিদ্র পরিবারগুলোর হাতে বন্যার ঠিক আগ মুহূর্তে খাবার ও পানিসহ প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য কেনার টাকা থাকে না। ঘোর ওই বিপদের সময় সুফল প্রকল্প থেকে তাদের কাউকে ৫ হাজার, কাউকে ৭ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়।
সুফল প্রকল্পের ইউনিয়ন মবিলাইজার মিন্টু রঞ্জন আচার্য্য জানান, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বন্যার আগাম বার্তা ও আগাম প্রস্তুতি নিতে তারা সহায়তা করে আসছেন।
লেঙ্গুরা ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মো. শাহেদ আহমেদ বলেন, ‘সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের কাছে আগাম তথ্য আসে, কখন শিলাবৃষ্টি হবে, কখন বজ্রপাত হবে। সে অনুযায়ী আমি এলাকার বাসিন্দাদের তথ্য জানিয়ে দিই। এতে এলাকাবাসী সতর্ক হন, পূর্বপ্রস্তুতি নেন।’
মন্তব্য করুন