বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ২৩ আশ্বিন ১৪৩২
এ জেড ভূঁইয়া আনাস
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নিষ্পত্তি হলেও আদায় সামান্যই

অর্থঋণের মামলা
নিষ্পত্তি হলেও আদায় সামান্যই

দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে বিচারিক প্রক্রিয়া দৃশ্যমান তেমন কোনো ফল বয়ে আনছে না। অর্থঋণ আদালতে লাখ লাখ মামলা নিষ্পত্তি হলেও অনাদায়ি ঋণের অর্থ আদায় হচ্ছে সামান্যই। বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ও আটকে থাকা অর্থের পরিমাণও দিন দিন বেড়ে চলেছে, যা ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের হুমকি তৈরি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালতে এযাবৎকালে নিষ্পত্তি হয়েছে মোট ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৪৭টি মামলা। এসব নিষ্পত্তিকৃত মামলার বিপরীতে ব্যাংকগুলো আদায় করতে পেরেছে মাত্র ২৬ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। অথচ এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংকের মোট পাওনা ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে বটে; কিন্তু সে তুলনায় অর্থ আদায়ের হার অত্যন্ত নগণ্য- যা মোট পাওনার ২৩ শতাংশেরও কম।

গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে হওয়া মামলার মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৯১টি। এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনার পরিমাণ ৩ লাখ ৪৩ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৭০ হাজার ৩৪৩টি। বিচারাধীন এসব মামলায় আটকে আছে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। তবে বিপুল এ অর্থের বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা, যা মোট পাওনার মাত্র ৩ শতাংশ।

গত বছরের জুন পর্যন্ত সময়ের তথ্য অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৬৭ হাজার ৫১৯টি। যেসব মামলার বিপরীতে আটকে আছে ২ লাখ ৯ হাজার ৬৯১ কোটি ৪ লাখ টাকা। এর বাইরে উচ্চ আদালতের দেওয়া স্থিতাবস্থার (স্টে অর্ডার) কারণে অতিরিক্ত আরও প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকা আটকে ছিল। অর্থাৎ, বিচারিক প্রক্রিয়া ও উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ মিলিয়ে প্রায় ২ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ আটকে আছে, যা দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থঋণ আদালতের কার্যক্রমে ধীরগতি, ঋণগ্রহীতাদের দীর্ঘমেয়াদি আইনি কৌশল, উচ্চ আদালতে আপিল ও স্থগিতাদেশ গ্রহণ এবং অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়াই অনাদায়ি ঋণ আদায়ের এমন চিত্রের জন্য দায়ী। এসব কারণে মামলার মাধ্যমে ঋণ পুনরুদ্ধার এখন কার্যত একটি ‘অকার্যকর’ প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে।

শুধু অর্থঋণ আদালতেই নয়, অর্থ জারি মামলার ক্ষেত্রেও একই রকম চিত্র দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাত থেকে হওয়া অর্থ জারি মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৯২৩টি। এসব মামলার বিপরীতে আটকে আছে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে, অর্থঋণ আদালতে থাকা মামলার বিপরীতে আটকে আছে আরও বিপুল অঙ্কের অর্থ। সব মিলিয়ে অর্থঋণ মামলা ও অর্থ জারি মামলার কারণে মামলার জটের ফাঁদে আটকে আছে মোট ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশে ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মামলার কারণে আটকে থাকা অনাদায়ি অর্থ দেশের মোট ব্যাংক ঋণের প্রায় ২০ দশমিক ৪১ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে বড় অঙ্কের অনাদায়ি অর্থ যদি দীর্ঘ সময় ধরে নিষ্পত্তিহীন থাকে, তাহলে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট আরও বাড়তে পারে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো কাগজে-কলমে জয়ী হলেও বাস্তবে অর্থ আদায় করতে পারছে না, যার ফলে খেলাপি সংস্কৃতি আরও উৎসাহিত হচ্ছে। উচ্চ আদালতের দীর্ঘস্থায়ী স্থগিতাদেশ ও আইনি জটিলতা ঋণগ্রহীতাদের পক্ষে সময়ক্ষেপণের সুযোগ তৈরি করছে। জরুরি ভিত্তিতে অর্থঋণ আদালতের সংস্কার, নির্দিষ্ট সময়সীমায় মামলা নিষ্পত্তি এবং রায় কার্যকরে কঠোর প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত না করলে ব্যাংক খাতের ওপর আস্থার সংকট আরও তীব্র হবে।’

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরও তীব্র, নতুন করে ঋণ বিতরণ ব্যাহত এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি, আইনি জটিলতা কমানো এবং ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য বিকল্প পন্থা চালুর ওপর জোর দেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকও ঋণ পুনরুদ্ধারে গতি আনতে ইতোমধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং ‘সংস্কার-অনাগ্রহী’ বিচারিক কাঠামোর কারণে এসব উদ্যোগ এখনো উল্লেখযোগ্য ফল দিতে পারেনি।

এ প্রসঙ্গে এক ব্যাংক নির্বাহী কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা অনেক সময় মামলায় জয়ী হই; কিন্তু টাকা আদায় করতে পারি না। কারণ, রায় কার্যকর করার মতো কাঠামো আমাদের নেই। অধিকাংশ খেলাপি ঋণগ্রহীতা বিভিন্ন অজুহাতে অর্থ লুকিয়ে রাখে বা স্থগিতাদেশ নিয়ে বছরের পর বছর পার করে দেয়।’

অর্থঋণ আদালতের উদ্দেশ্য ছিল ঋণ-সংক্রান্ত মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি ও অর্থ আদায় নিশ্চিত করা; কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, এই উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি, বরং মামলা দায়ের, শুনানি ও রায় কার্যকরের দীর্ঘসূত্রতা ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থার উত্তরণে প্রয়োজন অর্থঋণ আদালতের সংস্কার, মামলার সময়সীমা নির্ধারণ, রায় বাস্তবায়নে প্রশাসনিক সহায়তা এবং খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের সম্পদের তথ্য অনুসন্ধান ও বাজেয়াপ্তির ব্যবস্থা। অন্যথায়, দেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো কঠিন হয়ে পড়বে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিয়ানমারে বৌদ্ধদের উৎসবে জান্তার বিমান হামলায় নিহত ৪০

আ.লীগের কর্মী-সমর্থকদের জন্য কেঁদে কেঁদে দোয়া করলেন হাদি

তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারে ভুল উদ্ধৃতি সংশোধনের আহ্বান টিআইবির

‘আবরারের স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে অনেকের গাত্রদাহ দেখেছি’

সৌন্দর্যবর্ধনে সাভার উপজেলা প্রশাসনের নানা উদ্যোগ

ছেলের দায়ের করা মামলায় বাবাসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড

ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে কোরআন অবমাননা, সিএমপির জরুরি সতর্কবার্তা

জাতীয়করণ নিয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি তারেক রহমানের বার্তা

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩১ দফার লিফলেট বিতরণ

খেলা শেষ হতেই রেফারির ওপর হামলা

১০

জোর করে পদত্যাগ করানো শিক্ষকদের জন্য সুখবর

১১

আদালতের ‘ন্যায়কুঞ্জে’ খাবার হোটেল, প্রধান বিচারপতির নির্দেশে উচ্ছেদ

১২

অ্যানথ্রাক্স ছড়াচ্ছে উত্তরাঞ্চলে, রংপুর-গাইবান্ধায় সরেজমিনে তদন্ত শুরু

১৩

চীন থেকে যুদ্ধবিমান কেনা প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা / জানলে যে সব বলে দিতে হবে সেটা তো না

১৪

শেখ হাসিনা ও কামালের নির্বাচনী যোগ্যতা নিয়ে যা জানা গেল

১৫

ছাত্রদলকে সমর্থন জানিয়ে চাকসু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন দুই প্রার্থী

১৬

খুন করে আল্লাহর ভয়ে নামাজ পড়ে ক্ষমা চান হত্যাকারীরা

১৭

ইংলিশদের বিপক্ষে মারুফাদের লড়াই করে হার

১৮

পিআর নিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ব : চরমোনাই পীর

১৯

ফুটবলকে বিদায় বললেন মেসির আরও এক সতীর্থ

২০
X