রাজধানী ঢাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে শুরু করা হয় ‘ঢাকা এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই’ শীর্ষক প্রকল্প। লক্ষ্য ছিল নগরবাসীর জন্য টেকসই পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে পানি সংগ্রহ, পরিশোধন ও বিতরণ ব্যবস্থার পাশাপাশি বিদ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হয়নি; বরং বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণে খরচ বেড়েছে লাফিয়ে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পানি সংকট নিরসনে পাঁচ বছরের মধ্যে টেকসই পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো কাজ শেষ হয়নি। বারবার প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় সংশোধনের ফলে অনুমোদনের চেয়ে ব্যয়
বেড়ে দাঁড়াচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি, আর সময় বাড়ছে ৮ বছর।
জানা গেছে, স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ওয়াসা। টেকসই পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে মেঘনা নদী থেকে পানি এনে গন্ধর্বপুরে ৫০০ এমএলডি ক্ষমতার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও বিশনন্দীতে ১ হাজার ৫০ এমএলডি ক্ষমতার ইনটেক স্টেশন নির্মাণ করা। এ ছাড়া ট্রান্সমিশন লাইন, বিতরণ নেটওয়ার্ক উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ও ফরাসি উন্নয়ন সংস্থার (এএফডি) অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি প্রথম অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। কিন্তু কয়েক ধাপে সময় বাড়ার পাশাপাশি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। নতুন করে আরও ২ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা এবং আরও দুই বছর সময় চেয়ে তৃতীয়বার সংশোধনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী, এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা এবং সময় চাওয়া হয়েছে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত। অর্থাৎ কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি, নতুন এলাকা যুক্ত হওয়া, ইউটিলিটি শিফটিং, নকশা পরিবর্তন, পরামর্শক ব্যয়, ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে তিন দফা সংশোধনে মূল অনুমোদনের চেয়ে ৫ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা আর পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পের মেয়াদ গিয়ে ঠেকছে ১৩ বছরে।
সর্বশেষ সংশোধনী প্রস্তাবে ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ডলারের দাম ৮৪ থেকে ১২০ টাকা হওয়ায় ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা, ইউটিলিটি শিফটিং ও নকশা পরিবর্তনে বেড়েছে ৭০৬ কোটি টাকা, বিলম্বজনিত সুদ ও মূল্য সমন্বয়ে বেড়েছে ৪২৩ কোটি টাকা, কর-শুল্ক বৃদ্ধিতে বেড়েছে ৩৭০ কোটি এবং সড়ক খনন চার্জ ও সোলার সংযোগে বেড়েছে ১৪১ কোটি টাকা।
মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে বলা হয়েছে, জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, বিভিন্ন সংস্থার অনুমতি পেতে দীর্ঘসূত্রতা, ইউটিলিটি শিফটিংয়ে ধীরগতি ও নকশা পরিবর্তনের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত আলোচ্য প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮৯ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৮২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। তবে বাকি কাজ শেষ করতে আরও অন্তত দুই বছর সময় লাগবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ওয়াসার এই প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য আগামী রোববার অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে। ওই সভায় সভাপতিত্ব করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও একনেক চেয়ারপারসন ড. মুহম্মদ ইউনূস।
আলোচ্য সংশোধনীর বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভূ-উপরিস্থ পরিশোধিত পানি সরবরাহের মাধ্যমে টেকসই পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। তৃতীয় সংশোধন প্রস্তাব হওয়ায় প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপন করা হবে। এর আগে প্রকল্পটির ওপর গত ১৫ এপ্রিল পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার কিছু শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে প্রকল্পটি অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে।
তৃতীয় সংশোধনীর বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক ওয়াহিদুল ইসলাম মুরাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু প্রকল্পের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানীর বহু এলাকায় এখনো ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমেনি। ফলে নির্ধারিত সময়ের বহু পরেও এই প্রকল্পের সুফল অধরাই থেকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দীর্ঘসূত্রতা শুধু ব্যয় বাড়াচ্ছে না, দীর্ঘসূত্রতা প্রমাণ করে, আমাদের উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় কতটা দুর্বল। সময়মতো শেষ না হওয়া প্রকল্প মানে শুধু ব্যয় বৃদ্ধি নয়, জনগণও দীর্ঘ সময় সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। শুরুতেই সঠিক পরিকল্পনা ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা হলে মাঝপথে সংশোধনের প্রয়োজন কম হতো।
মন্তব্য করুন