কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ০৯:১৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিটিআরসিতে অবৈধ নিয়োগে চিহ্নিত যারা

তদন্ত প্রতিবেদন
বিটিআরসিতে অবৈধ নিয়োগে চিহ্নিত যারা

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ-পদোন্নতিতে ব্যাপক অনিয়ম ও কারসাজির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। গাড়িচালক থেকে শুরু করে পরিচালক, এমনকি কমিশনার ও পরামর্শক পদে নিয়োগেও আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে, যা বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণ মিলেছে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ আগস্ট বিটিআরসির অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। ওই চিঠিতে বলা হয়, বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিটিআরসির যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগে তদন্ত হয়েছে এবং অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, বিটিআরসিকে বিশেষ সহকারীর পক্ষ থেকে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে চাকরিবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা একাধিকবার তাগাদা দিলেও কেন বিটিআরসির অনীহা তা জানা নেই। নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনে আবারও তাগাদা দেওয়া হবে।

বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাগুলো আজ সোমবার অনুষ্ঠেয় বিটিআরসির ২৯৮তম কমিশন সভায় সংস্থাটির বিভিন্ন পদে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তদের বিষয়ে আলোচনা হবে। কমিশন সভার আলোচনায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা এবং তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত সুপারিশগুলো বিবেচনায় নিয়ে অভিযুক্তদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিটিআরসি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় থেকে বিটিআরসিকে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। ওই তালিকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়মের ধরন উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকায় বিধিবহির্ভূতভাবে রাজস্ব খাতে নিয়োগপ্রাপ্ত ২৯ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট এবং চাকরির বয়স না থাকলেও নিয়োগপ্রাপ্তদের তথ্য দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। অনেকে চাকরির বয়স না থাকায় অযোগ্য ছিলেন। এসব কর্মকর্তাকে বিধিবহির্ভূতভাবে প্রকল্পের মাধ্যমে রাজস্ব খাতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে পদোন্নতিতেও অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের নিরীক্ষায় কমিশনারসহ শতাধিক জনকে নিয়োগ ও অন্তত এক ডজন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও বিধি ভঙ্গ করে। ২৭ জন সহকারী পরিচালক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী পরিচালকসহ ২৯ জন ২০০৯ সালের কোনো প্রকার পরীক্ষায় ছাড়াই নিয়োগ পান।

একজনও বিভাগীয় প্রার্থী না হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে দেখিয়ে অনিয়ম করে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিভাগীয় প্রার্থী দেখিয়ে একজন উপপরিচালক, তিনজন জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক, পাঁচজন সহকারী পরিচালক, একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ১১ জন উপসহকারী পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ২৯ জন: মন্ত্রণালয়ের তালিকা থাকা বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান উপপরিচালক পদে কর্মরত খালিদ ফয়সাল রহমান, নাহিদুল হাসান, শারমিন সুলতানা, তাসমিয়া তাহমিদ, মিরাজুল ইসলাম, তৌহিদ হোসেন, এসএম তাইফুর রাহমান, রোখসানা মেহজাবীন, রাইসুল ইসলাম, মো. আসাদুজ্জামান, তৌহিদুর নাহার, নাফিসা মল্লিক, মাহরীন আহসান, সামিরা তাবাসসুম, এসএম গোলাম সারোয়ার, মেহফুজ বিন খালেদ, শামসুজ্জোহা এবং সহকারী পরিচালক কাউসার আহমেদ, শামসুল আলম ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক মশিউর রহমান।

এ ছাড়া, চাকরি ছেড়ে যাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সহকারী পরিচালক রহমান খান, খান মোহম্মদ ফুয়াদ বিন এনায়েত, কাজি আফরোজা সুলতানা, ফারিহা আহসান, কাজি মাহমুদুর রহমান, কাজি রাফসান ইয়াসদানি, শারমিন কিবরিয়া, আস্রার আহমেদ খান।

বয়স না থাকা সত্ত্বেও ৩০ জনের নিয়োগ: সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা অতিক্রম করার পরও প্রার্থীদের বয়স প্রমার্জন করে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে। এমন ৩০ জনের একটি তালিকা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক পদ থেকে শুরু করে অফিস সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, এমএলএসএস ও ড্রাইভার পদও রয়েছে। নথি অনুযায়ী, এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়স প্রমার্জন করা হয়েছে কয়েক মাস থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৬ বছর পর্যন্ত। সবচেয়ে বড় অনিয়ম ধরা পড়েছে একজন কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে, যেখানে প্রার্থীর ১৬ বছর আগেই চাকরির বয়স শেষ হয়ে গিয়েছিল।

উপপরিচালক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত গোলাম রাজ্জাকের বয়স প্রমার্জন করা হয়েছে ১ বছর ৯ মাস ২২ দিন। সহকারী পরিচালক পদে খালেদ ফয়সল রহমান, তৌহিদুর নাহার, নাহিদুল হাসান ও শারমিন সুলতানার বিভিন্ন মেয়াদে বয়সও প্রমার্জন করা হয়েছে।

একইভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তা কাউছার আহমেদ, অফিস সহকারী রেজাউল করিম, কম্পিউটার অপারেটর রাশেদুল ইসলাম, অফিস সহকারী শেখ মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রটোকল সহকারী দেওয়ান মো. ফারুক আহমেদকে বয়স দীর্ঘ মেয়াদে প্রমার্জন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ফারুক আহমেদকে ৬ বছর এবং মোয়াজ্জেম হোসেনকে ১৬ বছর বয়স প্রমার্জন করা হয়। রেজাউল করিম এবং কাউছার আহমেদের ক্ষেত্রে বয়স প্রমার্জন করা হয় ৫ বছরেরও অধিক।

তালিকা অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে এমএলএসএস বা ক্লিনার ও ড্রাইভার পদে। এই পদে হারুনর রশিদ, তাইফুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, আবুল কালাম, আইনুল হক, ময়না খাতুন ও আ. জলিল হাওলাদারকে বয়স প্রমার্জন করে নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে জলিল হাওলাদারকে প্রায় ১০ বছর এবং তাইফুর রহমান ও হারুনর রশিদের ক্ষেত্রে ৪ এবং ৬ বছরের অধিক বয়স প্রমার্জন করা হয়েছে। বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে বয়স প্রমার্জন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

ড্রাইভার পদে ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয় প্রমার্জিত বয়সের ভিত্তিতে। এর মধ্যে শহীদ আলী বাবুর ৭ বছর, মুক্তার হোসেনের ৫ বছর ৭ মাস বয়স প্রমার্জন করা হয়। এ ছাড়া ছাইদুল ইসলাম এবং আব্দুল খালেকের ক্ষেত্রে প্রায় ৫ বছর করে বয়স প্রমার্জন করা হয়েছে। বাকি রাশীদুল ইসলাম, আব্দুস সালাম, আল মাসুদ, জাহিদ হোসেনসহ অন্যদের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৪ বছর পর্যন্ত বয়স প্রমার্জন করা হয়। বয়স প্রমার্জনের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ড্রাইভারদের মধ্যে এরই মধ্যে চারজন এখন বিটিআরসিতে কর্মরত নেই।

এদিকে, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে যাদের নাম তদন্তে উঠে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছেন বিটিআরসির সাবেক কমিশনার ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী, মহাপরিচালক (প্রশাসন) আব্দুল্লাহ আল মামুন, মহাপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগ) আশীষ কুমার কুণ্ডু, উপপরিচালক আসাদুজ্জামান, উপপরিচালক শারমিন সুলতানা, পরিচালক এম এ তালেব, পরিচালক আফতাব মো. ওয়াদুদ, পরিচালক মো. এয়াকুব আলী ভূঁইয়া, তৌফিকুল আলম।

জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে সব বিষয়ের ওপর নিরীক্ষা পরিচালিত হয় ২০২০ সালে। অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতিপ্রাপ্তদের বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে তদন্ত কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। সে প্রতিবেদনে অনিয়মের সত্যতা খুঁজে পায়। ২০২৩ সালে আবারও মন্ত্রণালয় কর্তৃক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও সেই প্রতিবেদনে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গত বছর গঠিত তদন্ত কমিটি চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতিবেদন জমা দিলেও এসব বিষয়ে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিটিআরসি।

সার্বিক বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারী (অব.) কালবেলাকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ সহকারীর নির্দেশনা পেয়েছি। সামনের কমিশন বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে, যা সিদ্ধান্ত হয় সেই আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শেখ হাসিনাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান, ভূতের মুখে রাম নাম : অ্যাটর্নি জেনারেল

ত্রিদেশীয় সিরিজের জন্য দল ঘোষণা, ফিরেছেন জুনায়েদ সিদ্দিক

ভিকির মতো শান্ত মানুষ সাইকো থ্রিলার ভাবেন কীভাবে: নাবিলা

চন্দ্রনাথ পাহাড় ঘিরে উসকানিমূলক কিছু দেখামাত্র ব্যবস্থার নির্দেশ

আবুল খায়ের গ্রুপে মার্কেটিং অফিসার পদে নিয়োগ

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ, আজই আবেদন করুন

রাজনীতিতে শিষ্টাচার-শুদ্ধাচারের আবশ্যকতা 

‘ফকিন্নির বাচ্চা’ মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিলেন রুমিন ফারহানা

সৌম্যদের অধিনায়কের দায়িত্ব পেলেন মোহাম্মদ মিঠুন

স্বর্ণকারের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় হোতাসহ গ্রেপ্তার ৭

১০

বিদ্রোহী কবির মৃত্যুবার্ষিকী / ‘বিদ্রোহী কবি’, ‘প্রেমের কবি’, ‘সাম্যের কবি’র প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা 

১১

ফোনের টাচ স্ক্রিন কাজ করছে না? চেষ্টা করুন এই ৬ উপায়

১২

অতিরিক্ত শুল্কের চাপে বন্ধ হচ্ছে ভারতের বড় শহরের পোশাক উৎপাদন

১৩

ভক্তদের সঙ্গে নামের অক্ষর খেলায় মেতেছেন মেহজাবীন

১৪

নির্বাচনের রোডম্যাপ অনুমোদন ইসির, যে কোনো সময় প্রকাশ

১৫

‘স্যার সময়মতো ক্লাসে আসেন না’ বলায় ৩৩ ছাত্রকে বেধড়ক পেটালেন শিক্ষক

১৬

চাকরির প্রলোভনে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ মাদ্রাসা সুপারের বিরুদ্ধে

১৭

টানা ৫ দিন বজ্রবৃষ্টি হতে পারে যেসব এলাকায়

১৮

বয়স বাড়লেও ব্রেন ঝকঝকে রাখার ৪ উপদেশ নিউরোলজিস্টদের

১৯

ফজলুর রহমানের বক্তব্যের কারণে দল বিব্রত : প্রিন্স

২০
X