বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ ১২ ভাদ্র, তার ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। তিনি অবিভক্ত বাংলার (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ) বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ সালের ২৫ মে) জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মায়ের নাম জাহেদা খাতুন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রেম, বিরহ-বেদনা ও সাম্যের কবি। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্য-সংগীত তথ্য সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান পুরুষ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় কাজী নজরুল ইসলামের লেখনী ধুমকেতুর মতো আঘাত করে জাগিয়ে তুলেছিল ভারতবাসীকে। বিদ্রোহী কবিতে পরিণত হন তিনি। কবি সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, নিপীড়ন, অনাচার, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে অগ্নিকণ্ঠে সোচ্চার হয়ে লিখেছেন অসংখ্য গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও গান। এ ছাড়া তিনি ছিলেন চির প্রেমের কবি। প্রেম নিয়েছিলেন এবং দিয়েছিলেন। তিনি বিদ্রোহী কবি হলেও তার প্রেমিক রূপ ছিল প্রবাদপ্রতিম। এ কারণেই অনায়াসে এ কবি বলে গেছেন, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন, খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ এ ছাড়াও একাধারে তিনি কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিশু সাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, গীতিকার, সুরকার, স্বরলিপিকার, গীতিনাট্যকার, গীতালেখ্য রচয়িতা, চলচ্চিত্র কাহিনিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, সংগীত পরিচালক, গায়ক, বাদক, সংগীতজ্ঞ ও অভিনেতা ছিলেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখে গেছেন ২২টি কাব্যগ্রন্থ, সাড়ে ৩ হাজার মতান্তরে ৭ হাজার গান সংবলিত ১৪টি সংগীত গ্রন্থ, তিনটি কাব্যানুবাদ ও তিনটি উপন্যাস গ্রন্থ, তিনটি নাটক, তিনটি গল্পগ্রন্থ, পাঁচটি প্রবন্ধ, দুটি কিশোর নাটিকা, দুটি কিশোর কাব্য, সাতটি চলচ্চিত্র কাহিনিসহ অসংখ্য কালজয়ী রচনা। এই শতবর্ষে দাঁড়িয়ে আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রাসঙ্গিকতা ও তার অম্লান তাৎপর্য্যরে কথা। উপনিবেশবাদের অবসান ঘটলেও বিশ্বায়নের শৃঙ্খল আর ধনতন্ত্রের শোষণ বঞ্চনা অত্যাচার নির্য্যাতনসহ আর্থসামাজিক বৈষম্য সবকিছুই বলবৎ আছে। ‘অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণে’র তলে ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল’ এই বাংলার আকাশে-বাতাসে আজও প্রতিনিয়ত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। অন্যদিকে মানুষের শক্তির প্রতি, তার বীরত্বের প্রতি অনাস্থাও সমানভাবে অটুট। তাই নজরুলের ভাষায়, শান্ত থাকার অবকাশ মিলছে না। চতুষ্পার্শ্বের প্রতিবাদহীন মেরুদণ্ডহীনতার পরিপ্রেক্ষিতে বিপুলভাবে কাম্য হয়ে উঠেছে ‘উন্নত মম শির’-এর বজ্রদীপ্ত ঘোষণা। শোষণ, পীড়ন আর বৈষম্য থেকে মুক্তির সংকল্প নিয়ে মানুষের অপরিমেয় শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়ে নজরুল-কথিত বিদ্রোহের রণে অবতীর্ণ হওয়ার যেন বিকল্প নেই।
বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম উসকে দিয়ে গেছেন তরুণ প্রজন্মকে। যদি করার মতো কোনো কাজ কেউ করতে পারে-তাহলে তা তরুণই, অন্য কেউ নন। তাই কবি নজরুল তার বিভিন্ন লেখা ও অভিভাষণে করে গেছেন তারুণ্যের জয়গান। তিনি বলেন ‘তারুণ্যকে, যৌবনকে আমি যেদিন হইতে গান গাহিতে শিখিয়াছি সেইদিন হইতে বারেবারে সালাম করিয়াছি, সশ্রদ্ধ নমস্কার নিবেদন করিয়াছি; জবাকুসুম-সঙ্কাশ তরুণ অরুণকে দেখিয়া প্রথম মানব যেমন করিয়া সশ্রদ্ধ নমস্কার করিয়াছিলেন, আমার প্রথম জাগরণ প্রভাতে তেমনি সশ্রদ্ধ বিস্ময় লইয়া যৌবনকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি; তাহার স্তবগান গাহিয়াছি।’
নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী কবি। তার বিদ্রোহী কবিতা মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বিভিন্ন পঙ্ক্তি, যেমন ‘চির-উন্নত মম শির’ শুনলে সকলের মনে এক ধরণের বিদ্রোহী মনোভাব সৃষ্টি হয়। যা সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আমাদের সাহস জোগায়। তিনি ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক কবি। কারণ তিনি ইসলামি গান (গজল) রচনা করছেন এবং একই সঙ্গে শ্যামা সংগীত লিখেছেন। কবি নজরুল সাম্যের কবি, প্রেমের কবি-সব বিশেষণেই আমরা তাঁকে বিশেষায়িত করতে পারি। কিন্তু সবার আগে কাজী নজরুল ইসলামের মূল্যায়ন হওয়া উচিত মানুষের কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি হিসেবে।
‘গাহি সাম্যের গান-যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’ বাঙালি যতদিন নজরুলের চেতনা ধারণ করতে পারবে,ততদিন জাতীয় জীবনে যতই বিঘ্ন-বিপদ আসুক, যতই প্রতিকূল অবস্থা হোক না কেন, বাংলাদেশ ও বাঙালির জয় সুনিশ্চিত। তারই নামে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, যা ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত। ১৫ একর জমি নিয়ে শুরু করে বর্তমানে ৫৭ একর জমিতে গড়ে উঠেছে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কুয়াশা উৎসব হয়। একমাত্র এখানেই এই সংস্কৃতির চর্চা হয়। যার মাধ্যমে আমাদের দেশ বা জাতির সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়। আশা করি, যত দিন বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তত দিন এই উৎসব উর্য্যাপন করবেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে সবুজায়ন, ফুলের বাগান হবে। সবুজে সবুজে আমাদের হৃদয় ভরে উঠুক নজরুল প্রাঙ্গণ। শিক্ষা, গবেষণা, গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত, শিক্ষার্থীদের নানা বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি। সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা এবং নিয়মতান্ত্রিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় কবির প্রেম ও চেতনায় এগিয়ে যাবে বলেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। বিশ্ববিদ্যালয়টি নতুন নতুন ফুলে ভরে উঠুক এবং প্রতিটি মানুষ ফুলের মতো তাদের কর্মজীবন পরিচালনা করুক কবির জন্মদিনে এটাই হোক আমাদের ভাবনা।
বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও কাজী নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তার লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তার কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।
১৯৭২ সালের ২৪ মে কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে তাকে ঢাকায় এনে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবির ‘চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’কে সামরিক সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করে তাকে সম্মানিত করা হয়। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি একুশে পদকে ভূষিত করা হয় কবিকে। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তার বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৪ সালে কবিকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়। জানা যায়, কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪১ সালের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসা চলে লুম্বিনী পার্ক ও রাচি মেন্টাল হাসপাতালে। পরে ১৯৫৩ সালে ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে পাঠানো হয় তাকে। এই সময়ে একেবারেই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। ফলে ১৯৫৩ থেকে ১৯৭২ সাল পর্য্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় নীরবে-নিভৃতেই কাটে তার জীবন।
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি (বর্তমানে বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্য্যাদায় সমাহিত করা হয় কবিকে। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার শতবর্ষ পূরণের এই বছরে আমরা যদি এর সৃষ্টি-উৎসের দিকে তাকাই, তাহলে অনেকগুলো তাৎপর্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাতে এক বৈঠকে রচিত হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের বিপুল প্রভাববিস্তারী এই কবিতা। নজরুল তখন মাত্র ২২ বছরের যুবক। সেনাবাহিনীর কর্ম শেষে কলকাতায় ফিরেছেন দুই বছরও হয়নি। ১৯২০-এর মার্চে কলকাতায় ফেরার পর বিপুল উদ্যমে তারুণ্যের তুমুল আবেগ-উচ্ছ্বাস নিয়ে তখন তিনি সাহিত্য সৃষ্টিতে আকণ্ঠ নিমগ্ন। সমানে লিখে চলেছেন গল্প-উপন্যাস-কবিতা-গান ও প্রবন্ধ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা হলো: গল্প ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘রাক্ষসী’; উপন্যাস বাঁধনহারা; কবিতা ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম’, ‘আগমনী’, ‘রণভেরী’, ‘আনোয়ার’, ‘কামাল পাশা’ প্রভৃতি। তবে এ সবকিছুকে ছাড়িয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ঘটেছিল তাঁর কবিত্বশক্তির সর্বোত্তম প্রকাশ। বিভিন্ন পুরাণের নির্যাসকে এ কবিতায় যে অসীম দক্ষতায় সৃষ্টিশীলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। যুদ্ধফেরত এই যুবকের মনে তখন প্রবলভাবে বহমান উপনিবেশবাদের শোষণ ও সাম্প্রদায়িক বিভেদনাশী এক সুগভীর প্রতিবাদী চেতনা।
আজকের দিনে তাকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা। কবি কাজী নজরুল ইসলাম অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। যে কারণে নানা কাজ বা সিদ্ধান্তে প্রতিনিয়ত স্মরণ করি। জাতীয় কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটি ছিল চমৎকার। তাঁর চিন্তা-চেতনা আমাদের কর্ম ও সামাজিক জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কবি নজরুল স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন ১৯৭২ সালের ২৪ মে। সেদিন ছিল কবির ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। কিন্তু ১৯৪২ সালে তার জাগতিক চেতনা লুপ্ত হয়। কবি হিসেবে তার মৃত্যু হয় ৭৯ বছর আগে। যদি স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতেন, তিনি বিশ্বের ইতিহাসে অনেক কবিকে ছাড়িয়ে জেতেন। কারণ তাঁর মেধা এবং প্রজ্ঞা ছিল অসাধারণ। ‘বিদ্রোহী কবি’, ‘প্রেমের কবি’, ‘সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি রইলো অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
লেখক : ড. মো. আনোয়ার হোসেন (প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল)।
মন্তব্য করুন