বন্দর ব্যবহারকারীদের আপত্তি সত্ত্বেও এক মাস স্থগিত রাখার পর বিভিন্ন সেবার বিপরীতে গড়ে ৪১ শতাংশ হারে অতিরিক্ত মাশুল আদায় করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই মাশুলের বড় অংশ আদায় করা হবে শিপিং লাইন থেকে। একাংশ পরিশোধ করবে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকরা। শিপিং লাইন বন্দরের বাড়তি খরচ তুলে নেবে আমদানিকারক-রপ্তানিকারকের কাছ থেকে।
আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক বাড়তি খরচ পণ্যের দামে যুক্ত করবে। এদিকে এরই মধ্যে এবার ৭০ শতাংশ সারচার্জ সমন্বয় করবে শিপিং সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলো, এমনটাই জানিয়েছে শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, নতুন মাশুল কার্যকরের পর দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ব্যয়বহুল বন্দরে পরিণত হবে চট্টগ্রাম বন্দর।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, এ সারচার্জ বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে চট্টগ্রাম বা দেশের অন্য যে কোনো স্থানে পরিশোধ করতে হবে। বিদেশি প্রিন্সিপালরা বাধ্য হবে অন্য অঞ্চলের বন্দর ব্যবহার করতে, যার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসার হার কমবে। অতিরিক্ত খরচ আমদানির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং রপ্তানিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতাহীন করে তুলবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক কালবেলাকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন ট্যারিফ বুধবার থেকে কার্যকর হয়েছে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসা কয়েকটি জাহাজ সেই নতুন ট্যারিফের আওতাভুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ কালবেলাকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ৪১ শতাংশ ট্যারিফ কার্যকর করেছে। শুধু শিপিং সেক্টর নয়, এর সঙ্গে অনেক বডি জড়িত। কেউ তো এই বর্ধিত টাকা নিজের পকেট থেকে দেবে না। সুতরাং শিপিং সেক্টরে সার্বিকভাবে ৭০ শতাংশ সারচার্জ সমন্বয় করতে যাচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদেরই পরিশোধ করতে হবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান বরাবর গত ৫ অক্টোবর একটি চিঠি লেখে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। সেখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে একটি ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজের জন্য টাগ ভাড়া ২ হাজার ৯০৭ দশমিক ২০ মার্কিন ডলার (১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ)। নতুন ট্যারিফ অনুযায়ী, একই জাহাজের জন্য টাগ ভাড়া নির্ধারিত হয়েছে ১৫ হাজার ৭০৯ ডলার, ভ্যাটসহ যা ৫০০ শতাংশের বেশি। এত বড় বৃদ্ধির নজির নেই এবং এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিপিং শিল্পের জন্য অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়। নতুন ট্যারিফ তালিকায় সামগ্রিকভাবে প্রায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে, যা কোনোভাবেই যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য নয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বেশিরভাগ ট্যারিফ আইটেম সরাসরি শিপিং লাইনের বহনযোগ্য খরচ।
এদিকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত কনটেইনার পরিবহন সংস্থা মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানি (এমএসসি) বাংলাদেশ থেকে আমদানি-রপ্তানি করা সব ধরনের পণ্য পরিবহনের ওপর সারচার্জ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। পোর্ট কস্ট রিকভারি সারচার্জ (পিসিআর) আরোপ করা হচ্ছে বলে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এমএসসি দুই ধাপে এই সারচার্জ কার্যকর করবে। এর মধ্যে ১৬ অক্টোবর থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে এবং বাংলাদেশে সব গন্তব্য ও উৎসের (যুক্তরাষ্ট্র ও দূরপ্রাচ্য ছাড়া) চালানের ক্ষেত্রে সারচার্জ কার্যকর হবে। দ্বিতীয় ধাপে ১০ নভেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্র অভিমুখী ও যুক্তরাষ্ট্রগামী এবং বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব চালানের ক্ষেত্রে সারচার্জ কার্যকর করা হবে।
বাড়তি মাশুলের কারণে বন্দর খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন শিপিং লাইনগুলোও বন্দরের চেয়ে আরও বেশি হারে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ঘোষণা দিতে শুরু করেছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার ডেনমার্কভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানি মায়ের্সক লাইন চার্জ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ মাশুল বাড়ানোর কারণে কোম্পানিটির খরচ বাড়ায় নতুন হারের কথা জানিয়ে অনলাইনে ঘোষণা দেয়।
মায়ের্সক লাইনের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০ ফুট কনটেইনারে কোম্পানিটি টার্মিনাল হ্যান্ডলিং চার্জ বা টিএইচসি আগে আদায় করত ১২০ ডলার। বুধবার থেকে আদায় শুরু হয়েছে ১৬৫ ডলার। এ হিসাবে প্রতিটি কনটেইনারে ৪৫ ডলার বাড়িয়েছে তারা। তবে ৪০ ফুট লম্বা কনটেইনারে এই চার্জ ২০৫ থেকে ৩১০ ডলার বাড়িয়েছে।
এর আগে ৭ অক্টোবর সিএমএ সিজিএম, সিএনসি ও এএনএল—এই তিন লাইন ২৬ অক্টোবর থেকে ২০ ফুট লম্বা কনটেইনারে ৪৫ ডলার বাড়তি সারচার্জ আদায়ের ঘোষণা দিয়েছে।
কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া ঘোষণায়, কনটেইনারভেদে আমদানি-রপ্তানিতে এই সারচার্জ আরোপ করা হয়। প্রতিটি সাধারণ কনটেইনারের বিপরীতে সারচার্জ ১০০ ডলার, রিফার কনটেইনারের জন্য ১৫০ ডলার, ওওজি (আউট অব গেস) কনটেইনারের জন্য ১৫০ ডলার এবং আইএমও কনটেইনারের জন্য ২০০ ডলার সারচার্জ আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি ও কেডিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রহমান কালবেলাকে বলেন, বাড়তি মাশুলের কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। রপ্তানি খাতে একটা অংশ ক্রেতারা দিলেও দিন শেষে এটা পণ্যের দামের সঙ্গে হিসাব হবে। বিদেশি ক্রেতারা বাড়তি দাম দিতে চাইবে না। তাহলে রপ্তানিকারকদের বোঝা বহন করতে হবে। রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পোশাকের কার্যাদেশ নেওয়া যাবে না।
মন্তব্য করুন