বৃষ্টি আর উজানের ঢলে নদীর পানি বেড়ে দেশের কয়েক জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে দুর্গত এলাকার লাখো মানুষ। কোথাও কোথাও পানি নেমে ভাঙনের ক্ষতচিহ্ন ভেসে উঠেছে। তাতে যাতায়াতে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ—এ ছয় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। তবে সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে।
উত্তরের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ধীরগতিতে বাড়তে পারে। আগামী ৭২ ঘণ্টা গঙ্গা ও পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ঘাঘট নদীর পানি সমতলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় দ্রুত বাড়তে পারে। তাতে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সমতল কিছু পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পাশাপাশি ঘাঘট নদী-সংলগ্ন গাইবান্ধা জেলার কিছু নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে।
আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যমুনেশ্বরী, করতোয়া, বাঙ্গালী, আপার করতোয়া, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, ইছামতী-যমুনা, আত্রাই, মহানন্দা এবং ছোট যমুনা নদীর পানিও সমতল সময় বিশেষে দ্রুত বাড়তে পারে। তবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল সার্বিকভাবে কমছে, এ অবস্থা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, বন্যার পানি এখনো ২১টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে আছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে পানি আগামী দুদিন কিছুটা বাড়বে, তবে ধীরগতিতে। ৭ তারিখের পর আশা করি বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, দেশের উত্তরাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারি থেকে অতি ভারি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ শনিবার রংপুর বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে রংপুর ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে।
কুড়িগ্রামের ১৬টি নদনদীর পানি বেড়ে দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মুসার চরের বাসিন্দা লালবানু বলেন, ‘হামার বাড়ির চারপাকে পানি। কোনো জাগাত শুকনা জাগা নাই। দুপুর পর্যন্ত না খাওয়া আছি, কাইয়্যো আসে নাই খোঁজ নিবার।’
নদীর পানি বেড়ে জেলার ৯ উপজেলার ৪২১টি চর-দ্বীপচরের প্রায় দেড় লাখেরও বেশি মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। সরেজমিন দেখা যায়, অনেকেই ঘরের চালা ও ঘরের ভেতর মাচা করে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ উঠেছেন উঁচু বাঁধে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নারী, শিশু ও বয়স্করা। রান্না করা খাবারের সংকট, দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। নৌকা ও কলাগাছের ভেলায় যাতায়াত করছেন মানুষজন। ইতোমধ্যে শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চর বালাডোবার বাসিন্দা ইব্রাহিম বলেন, ‘চার দিন থাকি হামার বাড়িত পানি। ঘরের ভিতরে পানি থাকার কারণে চালত আশ্রয় নিছি।’
চরগুজিমারী গ্রামের বৃদ্ধ শামসুল আলম-আঞ্জুয়ারা বেগম দম্পতি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘চার দিন ধরে নৌকায় খুব কষ্ট করে আছি। ঘরের ভেতর একগলা পানি। বউ-ছেলে-নাতিসহ নৌকায় রান্না করি, নৌকায় খাই, নৌকায় ঘুমাই। খুব কষ্টে আছি বাহে।’
জেলা প্রশাসক সাইদুল আরিফ বলেন, ইতোমধ্যে ১৭৬ টন চাল ও ১০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বিতরণ চলছে। নতুন করে আরও ৫০০ টন চাল ও ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। দুর্গত মানুষকে বিতরণ করা হবে।
জামালপুরে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্লাবিত হয়েছে অনেক এলাকা। জেলার দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ ও বকশীগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু এলাকায়। পানীয় জল ও টয়লেট সুবিধার তীব্র সংকটে দিন কাটছে তাদের। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ রয়েছে।
গাইবান্ধায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ২০ হাজার পরিবার। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে আউশ ধান, পাট, ভুট্টা ও আমন বীজতলাসহ আড়াই হাজার হেক্টরের অধিক জমির ফসল। ভেসে গেছে পুকুর ও মাছের ঘের। পানি ওঠায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে জেলার ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পানিবন্দি এসব এলাকার মানুষ
শিশু-বৃদ্ধ ও গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। প্রকট আকার ধারণ করেছে গো-খাদ্যসহ বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা।
টাঙ্গাইলে যমুনা নদীসহ জেলার সব নদীর পানি কয়েকদিন ধরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। শেরপুরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ২০ হাজার মানুষ। টানা দুদিন পর চার নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও দুর্ভোগ কমেনি নিম্নাঞ্চলের মানুষের।
সিলেটে তৃতীয় দফার বন্যায় ভালো নেই সীমান্তবর্তী উপজেলার মানুষ। বন্যার কারণে দুর্ভোগ যেন পিছু ছাড়ছে না বানবাসীদের। আশ্রয়কেন্দ্রে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বন্যায় অসহায় হয়ে পড়া লোকজন। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবের পাশাপাশি পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। বন্যার কারণে সড়ক, কৃষি, মৎস্য, অবকাঠামোসহ নানা খাতে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের উত্তর-পূর্বের এই জেলা। পাঁচশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
জেলার ১৩ উপজেলায় ১০১টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ১ হাজার ১৮০টি গ্রামের ৬ লাখ ২৬ হাজার ১৩৮ জন মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার দিয়ে প্রবাহিত কুশিয়ারা নদীর কয়েকটি স্থানে ডাইক ভেঙে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে জকিগঞ্জ উপজেলা সদরের ছবড়িয়া, রারাই, বাখরশাল, নরসিংহপুর ও পৌর এলাকা প্লাবিত হয়। ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে বাজারে প্রবেশ করছে। এতে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার, মধ্যবাজার, পূর্ববাজারসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
বিয়ানীবাজার উপজেলার দেউলগ্রাম, গোবিন্দশ্রী, আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর, আলীনগর চরখাই এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। দেউলগ্রামের বাসিন্দা আহমদ হোসেন বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের বন্যায় তেমন সমস্যা না হলেও তৃতীয় ধাপে এসে তিন দিন ধরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিপাকে আছেন। ঘরের মধ্যে প্রায় হাঁটু সমান পানি। পরিবারের সদস্যরা স্বজনদের বাড়িতে অবস্থান করছেন।
জকিগঞ্জের বাসিন্দা কাজী জুবায়ের জানান, এক মাসের মধ্যে তিনবার এলাকাবাসী পানিবন্দি অবস্থায় কাটিয়েছেন। আমাদের ঈদটাও ভালো যায়নি। মূল সড়কে হাঁটুর ওপরে পানি ভেঙে যাওয়া-আসা করতে হয়। এর থেকে পরিত্রাণ কবে পাব কে জানে।
সিরাজগঞ্জেও যমুনার পানিতে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ৩ হাজার পরিবার। তলিয়ে গেছে এসব এলাকার জমির ফসল। বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ছয়টি পয়েন্টে ১ হাজার ৬২ মিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। পানি বাড়ার কারণে সারিয়াকান্দির চরগুলোর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তিন উপজেলার ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে।
সোনাতলা উপজেলার পাকুল্লা ইউনিয়নের রাধাকান্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের প্রধান সড়কটি পানিতে নিমজ্জিত। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের মাঠে প্রায় কোমর পর্যন্ত পানি। এতে বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বালুয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাঠে পানি না উঠলেও বিদ্যালয়ের চারপাশে পানি উঠেছে। এতে ওই বিদ্যালয়ের পাঠদানও বন্ধ রয়েছে। বালিয়াডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যালয়ের টিনের ঘরটি ডুবে গেছে। আর ভবনের নিচতলা পানিতে নিমজ্জিত। বর্তমানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৮টি ইউনিয়নের বেশকিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, অন্তত ৩ হাজার পরিবার বন্যাকবলিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছেন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ।
(প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন কালবেলার সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা)