২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিএসসি ইন হেলথ টেকনোলজি (ডেন্টাল) কোর্স চালু করে স্বাস্থ্য অধদিপ্তর। বিডিএস সমমানের কোর্স মনে করে এতে বহু শিক্ষার্থী ভর্তি হন। কিন্তু কোর্স শেষ করে বিপাকে পড়েন তারা। কাছাকাছি মানের কোর্স হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসার অনুমতি পাননি এসব শিক্ষার্থী। এমনকি তাদের জন্য হয়নি বিশেষ কাজের ব্যবস্থাও। এমন পরিস্থিতিতে কর্মজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। কর্মহীনতা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাদের।
জানা গেছে, ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের অধীনে চার বছর মেয়াদি বিএসসি ইন হেলথ টেকনোলজি (ডেন্টাল) কোর্স চালু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কোর্সটিতে তিন বছর একাডেমিক (ক্লিনিক্যাল) এবং এক বছর ইনকোর্স ট্রেনিংয়ের (ইন্টার্নি) ব্যবস্থা ছিল। ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোর্সটির নাম পরিবর্তন করে ব্যাচেলর অব ডেন্টিস্ট্রি অথবা বিএসসি ইন ডেন্টিস্ট্রি করার প্রস্তাব দেয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেটি অনুমোদন করেনি। এরপর ১০ বছর ধরে চলা এই কোর্সে ২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন শেষ হলেও কাজের কোনো হদিস মেলেনি।
চিকিৎসক পেশা নিবন্ধনকারী সংস্থা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) তপশিলভুক্ত না হওয়ায় এসব শিক্ষার্থী চিকিৎসকদের মতো রোগীদের সেবাদানের অনুমোদন পাননি। অন্যদিকে সরকারি চাকরিতেও এসব কোনো সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। এমনকি কাজের স্বীকৃতি ও চিকিৎসার অনুমোদন পেতে দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে এলেও সে বিষয়ে কর্ণপাত করেনি সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ। সমস্যার সমাধানে আদালতের আশ্রয় নিলেও গত ১১ বছরে আদালত থেকে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়নি। এসব জটিলতার কারণে ২০১৪-১৫ সেশন থেকে ভর্তি বন্ধ রাখা হয়।
২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সাইফুল ইকবাল বলেন, সরকার অনুমোদিত কারিকুলামে পড়াশোনা শেষে এখন আমরা বেকার। স্বীকৃতি নেই, নেই কর্মসংস্থানের সুযোগ।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানান, কারিকুলামের বিষয়বস্তু ক্লিনিক্যাল ও প্র্যাকটিসনির্ভর। অনেকাংশে বিডিএস কোর্স কারিকুলামের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। চার বছর মেয়াদি ডেন্টাল কোর্সটির তিন বছর একাডেমিক এবং শেষ এক বছর ইনকোর্স ট্রেনিংয়ের (ইন্টার্নি) মাধ্যমে শেষ হয়। এক বছরের ইনকোর্স প্রশিক্ষণ দেশের সরকারি ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল ইউনিটের বিভাগগুলোতে সম্পন্ন হয়। কোর্সটিতে ভর্তির যোগ্যতা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস অথবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিন-চার বছরের ডিপ্লোমা। এ কোর্সের একজন শিক্ষার্থীকে দন্তচিকিৎসা বিষয়ক হিউম্যান অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, মাইক্রোবায়োলজি, প্যাথলজি, ওরাল অ্যান্ড ডেন্টাল অ্যানাটমি, অর্থডোন্টিক্স, ডেন্টাল প্রস্থেটিক্স, ওরাল প্যাথলজি অ্যান্ড ওরাল মেডিসিন, কেমিস্ট্রি অব ডেন্টাল ম্যাটারিয়ালস, চিলড্রেন অ্যান্ড প্রিভেনটিভ ডেন্টিস্ট্রি, ডেন্টাল সার্জারি অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড অ্যানেসথেটিকস, জেনারেল অ্যান্ড ডেন্টাল ফার্মাকোলজি, কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি এবং ডেন্টাল রেডিওলজি ক্লিনিক্যাল বিষয়ে ব্যবহারিক পড়তে হয়। এমনকি শিক্ষার্থীদের ক্লাস, পরীক্ষা ও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণও দেন এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসকরা। কিন্তু কোর্সের নামের সঙ্গে টেকনোলজি শব্দটি যুক্ত থাকায় পেশাগত স্বীকৃতি দেয়নি বিএমডিসি।
পেশাগত নিশ্চয়তার দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সমস্যা সমাধানে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি কমিটির পক্ষ থেকে বিএমডিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারদের কাছে দুটি সুপারিশ দেওয়া হয়। বিএমডিসির কাছে পাঠানো সুপারিশে বিএসসি ইন হেলথ টেকনোলজি (ডেন্টাল) কোর্সটিকে অনুমোদন করে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ দিতে বলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো চিঠিতে কোর্সটির নাম পরিবর্তন করে ব্যাচেলর অব ডেন্টিস্ট্রি অথবা বিএসসি ইন ডেন্টিস্ট্রি করার সুপারিশ করা হয়। তবে অধিদপ্তরের এসব সুপারিশের কোনোটিই আমলে নেয়নি বিএমডিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
এ নিয়ে বিএসসি-ডেন্টাল শিক্ষার্থীরা উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন। আদালত অধিদপ্তরের সুপারিশ দুটিকে প্রত্যাহার করাকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং সুপারিশ দুটি বাস্তবায়নে রাষ্ট্রপক্ষ ও বিএমডিসিকে নির্দেশ দেন। পরে এ নির্দেশনার বিরুদ্ধে আপিল করে বিএমডিসি। যেটার নিষ্পত্তি এখনো হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে এখন বিএমডিসির কিছুই করার নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. লিয়াকত হোসেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, বিএসসি ইন হেলথ টেকনোলজিস্টদের বিষয়টি সমাধানের এখতিয়ার আমাদের নেই। কোর্স চালু করেছে সরকার। প্র্যাকটিসের স্বীকৃতির জন্য টেকনোলজিস্টরা উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। এখন উচ্চ আদালত যে রায় দেবেন, আমরা সেটা প্রতিপালন করব। রিট নিষ্পত্তির আগে এ বিষয়ে আর কিছু না বলাই বাঞ্ছনীয়।
তবে বিএসসি-ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মো. রাকিবুল হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছর মেয়াদি পেশাগত ডেন্টাল ডিগ্রি অর্জনের পরও বিএমডিসি নানা অজুহাত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ ডিগ্রিধারী গ্র্যাজুয়েটদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। বিএমডিসি আইনের ধারা সংশোধন নতুন কোনো বিষয় নয় কিংবা এ আইনও অপরিবর্তনীয় নয়। কোনোভাবেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা কাম্য হতে পারে না।