শিল্পাঞ্চলে আবারও দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা যেন থামছেই না। আন্দোলন-বিক্ষোভে নিয়মিত বন্ধ থাকছে বহু শিল্পকারখানা। শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, মালিকপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও গত দুদিন ধরে অস্থিরতা শুরু হয়েছে পোশাক কারখানাগুলোতে। গতকাল সোমবার সাভার-আশুলিয়ায় ৫২ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে হা-মীম, মুসলিম, নাসাসহ বড় শিল্পগ্রুপের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ নিয়ে পোশাক খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে জরুরি বৈঠকে করেছে তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ। গতকাল রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সংগঠনটির নেতারা বলেছেন, মজুরি বৃদ্ধিতে মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন ও বার্ষিক ১০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি অযৌক্তিক। এটি তারা মানতে রাজি নন। প্রয়োজনে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার কথাও বলেন তারা।
শিল্পাঞ্চলে মূলত শ্রমিক বিক্ষোভের সূত্রপাত সরকার পতনের পর থেকে। চলতি মাসের শুরুর দিকে আন্দোলনের শুরু হয় ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ডিইপিজেড)। আশুলিয়ার গণকবাড়ী এলাকায় ডিইপিজেডের সামনে চাকরির দাবি ও নিয়োগে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে বিক্ষোভ করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। এরপর সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের আরও কয়েকটি কারখানায়। প্রতিনিয়তই বিভিন্ন কারখানার সামনে জড়ো হয়ে চাকরির দাবি করতে থাকেন তারা। কোথাও কোথাও তারা কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেন। ওই সময় ছাত্রলীগ নেতা ও নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ইশতিয়াক আহম্মেদ হৃদয় নামে এক ব্যক্তির বক্তব্য ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যেখানে তাকে নাশকতা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শিল্পে অস্থিতিশীলতার উসকানি দিতে দেখা যায়। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একইভাবে বিভিন্ন এলাকায় শক্ত অবস্থান নেয় পুলিশ। এতে চাকরির দাবিতে আন্দোলন কিছুটা কমে আসে।
গত ১০ সেপ্টেম্বর নিয়োগে নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসে। সেদিন বিজিএমইএর পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, নতুন করে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকার এবং অবশ্যই যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
বিজিএমইএর পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপের পরও পোশাক কারখানায় বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। তারা মজুরি ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি এবং অন্যান্য দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এর জেরে প্রায় প্রতিদিনই বহু কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হচ্ছিল। এ ছাড়া বহু কারখানায় শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছিল। এরমধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বর ২১৯টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এসবের জেরে শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, বিজিএমইএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একাধিক বৈঠক করে। এসব বৈঠক থেকে শ্রমিকদের নানা দাবি মেনে নেওয়া হয়।
শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, শ্রমিকরা যেসব দাবি তুলেছে তার অনেকই শ্রম আইনে তাদের প্রাপ্য। তবে বিগত সময়ে তার অনেক দাবিই মালিকপক্ষ ভ্রুক্ষেপ করেনি। এখন পরিবর্তিত সময়ে সেসব দাবিই উঠে আসছে।
গতকাল নরসিংহপুরে নাসা গ্রুপে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ১৫ দফা দাবি তুলে ধরেন। সেখানে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ১০ শতাংশ করা, ঈদে ১২ দিন করে ছুটি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের অনুপাত নিয়ে কোনো দাবি তোলা হয়নি। কারখানা ফটকে হামলার চেষ্টার পর গত কয়েক দিন এ কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। এতে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এ ছাড়া জিএবি লিমিটেডের শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে ১০টি। কারখানার খাবারে সপ্তাহে দুই দিন গরুর মাংস, দুই দিন মুরগির মাংস এবং দুই দিন সবজির সঙ্গে ডিম দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে। পাশাপাশি জ্বর, মাথাব্যথার মতো সাধারণ সমস্যায় চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে এক দিনের ছুটি, বছরে একবার পিকনিকে নিয়ে যাওয়া, কমপক্ষে ১০ বছরের চাকরির নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু গত ৪ সেপ্টেম্বর শ্রমিকদের এসব দাবির বিষয়ে বলেছিলেন, ‘শ্রমিকদের দাবি পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে নারী-পুরুষের সমতা আনতে হবে। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না, তাদের চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রোডাকশনের চাপ কমাতে হবে—এগুলোই মূল দাবি। এ ছাড়া ছুটি ঠিকমতো দিতে হবে, শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন করা যাবে না, হাজিরা বোনাস বাড়াতে হবে। কোনো কারখানায় ৭ দফা, কোনো জায়গায় ১১ দফা, কোনো জায়গায় ১৫ দফা।’
কেন এই অস্থিরতা, কেন শিল্পাঞ্চল উত্তপ্ত তার পেছনে কারণ জানতে চাইলে এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘কারখানার মালিকানা বা বিজিএমইএর নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এখানে ভূমিকা রাখছে। আওয়ামী লীগের আমলে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ যাদের কাছে ছিল, এখন সেখান থেকে হাতবদল হওয়ার ব্যাপারটাও একটা ভূমিকা রাখছে। একটা শ্রেণি আছে, যখন এমন কোনো বিক্ষোভ হয়, তখন তারা কারখানার ভেতরে ঢুকে লুটপাট করে, তারাও আছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশ কিংবা শিল্প পুলিশ যে মীমাংসা বা নেগোসিয়েশন করে, এবার সে ব্যাপারটাও তেমন চোখে পড়েনি। শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তার ব্যাপারটাও তেমন চোখে পড়েনি। আমার মনে হয় শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে ব্যাপারগুলো দ্রুত সমাধান করা উচিত।’
অন্যদিকে শিল্প মালিকরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে শিল্পের নিরাপত্তা চান। ওই সময় থেকে শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তায় মাঠে নামে সেনাবাহিনী। তারপরই পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। যদিও গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও শ্রমিক অসন্তোষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কিছু কারখানায় শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ করছেন বলে জানা যায়। এর জেরে গতকাল ৫২টি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ ছিল। এর মধ্যে ৪৩টিতে ১৩ (১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি আর নয়টিতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব মানবেন না মালিকরা: বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে গতকালের জরুরি সভায় পোশাক শ্রমিকদের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১৮ দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ সময় বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, নির্বাচনের আগে গত ডিসেম্বরে চাপিয়ে দেওয়া মজুরি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ২০৬টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় শ্রমিকদের পক্ষ থেকে মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন এবং বার্ষিক ১০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
এরপর মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন সাধারণ গার্মেন্টস মালিকরা। প্যাট্রিয়ট গ্রুপের ইকবাল হোসেন বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংক ঋণের সুদ বেড়েছে। এ অবস্থায় সিএম (তৈরি খরচ) দিয়ে বিদ্যমান কাঠামোয় বেতন দেওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। নতুন মজুরি নির্ধারণে বোর্ড পুনর্গঠন কোনোভাবেই মানি না, মানব না। তিনি বলেন, পোশাক শিল্পের দিকে কালো ছায়া ধেয়ে আসছে। এটা প্রতিরোধ করতে না পারলে অর্থনীতি ও দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।
শহিদুল হক অপু বলেন, শ্রমিকদের জন্য আইন থাকলেও মালিকদের জন্য আইন নেই। ডিসেম্বরে মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে ৫ বছরের জন্য। এর এক দিন আগেও বোর্ড পুনর্গঠন সম্ভব না। মোস্তফা নামে আরেক গার্মেন্ট মালিক বলেন, গার্মেন্টস মালিকরা বৈষম্যের শিকার। গৃহকর্মী, যানবাহন বা অন্যকোনো শিল্পে মজুরি কাঠামো না থাকলেও গার্মেন্টস মালিকদের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওকোটেক্সের ইঞ্জিনিয়ার সোবহান বলেন, গণ্ডগোলের জন্য উপদেষ্টা পরিষদ দায়ী। কী কারণে ৯ মাস পার না হতেই তারা নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের বিষয়টি আলোচনায় আনেন। এ ধরনের বক্তব্য শ্রমিকদের মধ্যে যাওয়া মাত্রই একটি পক্ষ তাদের উসকানি দিচ্ছে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম পারভেজ বলেন, গত ৪ সপ্তাহে সরকার শিল্পকারখানায় কোনো নিরাপত্তা দেয়নি। অনেক চাপ সহ্য করেছি, আর না। এই মুহূর্তে শ্রমিকদের নতুন আর্থিক সুবিধা দেওয়া সম্ভব না। বেশি চাপাচাপি করলে চাবি বানিয়ে একটা শ্রমিকদের হাতে, আরেকটা সরকারের হাতে দিয়ে দেব। প্রয়োজনে সারা দেশে সব কারখানা এক সপ্তাহ বন্ধ রাখার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
সাবেক সভাপতি রেদোয়ান আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এসব করা হচ্ছে। শ্রমিকরা কাজ করতে না চাইলে মালিকদের কারখানায় তালা মেরে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। অসন্তোষ দমনে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হলেও তারা সেটি প্রয়োগ করছে না বলে মন্তব্য করেন রেদোয়ান।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সাভার ও টঙ্গী প্রতিনিধি)