রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বরে অবস্থিত দারুল কোরআন মাদ্রাসা। এলাকাবাসীসহ মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেশিরভাগেরই প্রত্যাশা এখানে উচ্চ শিক্ষার স্তর বাড়ানো; কিন্তু তাতে বাধা মাদ্রাসাটির মুহতামিম (অধ্যক্ষ) হাফেজ ইলিয়াস। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ—মাদ্রাসার কিতাব বিভাগের শিক্ষক মাওলানা আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে একজন শিক্ষক ও একজন শিক্ষার্থীকে দিয়ে স্পর্শকাতর অভিযোগ দায়ের করিয়েছেন। মূলত, নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বল্পতার কারণে মাদ্রাসায় মুহতামিম হিসেবে থাকতে পারবেন না এমন শঙ্কা থেকে তিনি এমনটি করেছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শুধু তাই নয়, যখন তিনি দেখলেন কোনো অভিযোগই প্রমাণ করা যাচ্ছে না, তখন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয় চাইলেন। সেই নেতা ও তার অনুসারীরা সম্প্রতি মাওলানা আরিফুল ইসলামকে মারধর করে। এখন তারা ওই শিক্ষককে মাদ্রাসা থেকে বের করে দিতে মরিয়া। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মুহতামিমের যোগসাজশে এসব ঘটনার পেছনে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়া, ৯১ নং ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মিটার সেলিম, তার অনুসারী নিশার, রাজন, নাজমুলসহ কয়েকজন জড়িত। যদিও অভিযুক্তরা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটিতে শুরু থেকেই হাফেজি চলমান আছে। এলাকাবাসীসহ মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা চাচ্ছিলেন এর শিক্ষার স্তর মাওলানা স্তর পর্যন্ত করতে। যে কারণে ২০২১ সালে মাদ্রাসাটিতে মাওলানা স্তর বা কিতাব বিভাগ চালু হয়। হাফেজ থেকে মাওলানা স্তরে পৌঁছাতে ৮ বছরের মতো সময় লাগে। এখন সেখানে তৃতীয় বছরের পাঠদান চলছে।
স্থানীয় ও মাদ্রাসা সূত্র জানিয়েছে, এলাকাবাসী ও মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টদের চাওয়ার কারণে মুহতামিম হাফেজ ইলিয়াস এখানে মাওলানা স্তর চালুতে বাধা দিতে পারেননি; কিন্তু প্রথমে বিষয়টি নিয়ে মুহতামিম কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও পরে কয়েকজন শিক্ষকের বিপক্ষে দাঁড়ান। মূলত, মাদ্রাসাটির শিক্ষার স্তর বাড়লে হাফেজ ইলিয়াস এখানে মুহতামিম হিসেবে থাকতে পারবেন না এমন শঙ্কা তার মনে বাসা বেঁধেছিল। সেক্ষেত্রে মাওলানা আরিফুল ইসলামের মুহতামিম হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল।
এ জন্য মুহতামিম প্রথমে মাদ্রাসার শিক্ষক মুয়াজ বিন কাসেমকে দিয়ে মাওলানা আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের একটি অভিযোগ দাখিল করেন। সেই অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি তদন্ত কমিটি। এরপর মাহবুব এলাহী নামক একজন শিক্ষার্থীকে দিয়ে বলাৎকারের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ পর্যন্ত তোলেন; কিন্তু সেটিও প্রমাণ করতে পারেননি মুহতামিম। এমনকি তিনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সামনে এই বলে মাফ চান যে, ইবলিশ শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তিনি এসব কাজ করেছেন। ভবিষ্যতে আর কখনো এসব কাজ করবেন না।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলে তিনি আবার বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। এবার তিনি স্থানীয় যুবদল ও বিএনপি নেতাদের শরণাপন্ন হন। স্থানীয় বিএনপি নেতা মিটার সেলিম তার অনুসারী নিয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে মাদ্রাসায় গিয়ে মাওলানা আরিফুল ইসলামের ওপর হামলা করেন। ওই শিক্ষক মাদ্রাসা না ছাড়লে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন।
মাদ্রাসার শিক্ষক মুয়াজ বিন কাসেম কালবেলাকে বলেন, বলাৎকারের অভিযোগটি মিথ্যা। এই অভিযোগ আমি আনিনি। মুহতামিম কেন অভিযোগ এনেছেন, তা জানি না।
ভুক্তভোগী শিক্ষক আরিফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, গত সোমবার রাত আনুমানিক ১১টার দিকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা দেখছিলাম। আমি তখন খোঁজ পাই, শিক্ষক মুয়াজ অনুপস্থিত। তার খোঁজে বের হলে এলাকাবাসী জানায়, মুয়াজ সাহেবকে রিকশায় করে একজন মাদ্রাসায় নামিয়ে দিয়ে গেছে। আমি মুয়াজ সাহেবকে না জানিয়ে বাইরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, বোর্ডিং ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী তাকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, মোহাম্মদ আলীর কাছে এই ঘটনার বিষয়ে যখন জানতে যাব, তখনই দরজায় কয়েকজন ধাক্কা দেয়। আমরা দরজা খুলে দিলে তারা ভেতরে ঢুকে মুয়াজ সাহেবকে কি জিজ্ঞেস করেছি, তা জানতে চায়। আমি তাদের ছাত্রদের সামনে কথা না বলে বাইরে গিয়ে কথা বলার অনুরোধ করলে পেছন থেকে কয়েকজন আমাকে আঘাত করে। পরে ছাত্ররা উপস্থিত হলে তারা চলে যায়। তিনি আরও বলেন, এই ঘটনার পেছনে মুহতামিমের যোগসূত্র আছে। কিতাব বিভাগের উন্নতি তিনি সহ্য করতে পারছেন না।
বলাৎকারের অভিযোগ তদন্তের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক ও স্থানীয়রা জানান, যখন মাওলানা আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, এটি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা অভিযোগ। মূলত সম্মানহানির জন্য এই অভিযোগ করা হয়েছে। পরে বিষয়টির জন্য সংশ্লিষ্টরা ক্ষমাও চেয়েছেন।
মাদ্রাসার বোর্ডিং ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী বলেন, সেদিন রাতে তদন্ত কমিটির সভায় গিয়েছিল মুয়াজ সাহেব। আমাকে বলা হয়েছিল তাকে নিয়ে যেতে; কিন্তু তিনি নিজ ইচ্ছাতেই গিয়েছেন, আমি তাকে নিয়ে যাইনি। তিনি মাদ্রাসায় আসার পরে আরিফুল ইসলাম তাকে ওপরে নিয়ে যান। তখন সেলিম সাহেব বিষয়টি জানতে পেরে মাদ্রাসায় আসেন। সেলিমকে কেন কল দিয়েছি, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো সমস্যা যেন না হয়, সেজন্য কল দেওয়া হয়। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কেউ কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, না। তবে স্থানীয় হিসেবে তাকে জানানো হয়েছিল। তিনি কমিটির সভায় উপস্থিত ছিলেন।
অভিযুক্ত মুহতামিম হাফেজ ইলিয়াস বলেন, আমিই কিতাব বিভাগ মাদ্রাসায় খুলেছি। কাজেই বিরোধিতার কোনো প্রশ্নই আসে না। আর আমার বিরুদ্ধে যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে জোর করে স্টেটমেন্ট দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটিও মিথ্যা। আমি ওই অভিযোগ তোলার জন্য কারও কাছে ক্ষমাও চাইনি। এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। তিনি বলেন, সেদিন রাতে কি হয়েছিল, তা আমি জানি না। হামলা হয়েছিল কি না, তাও জানা নেই। কি কারণে মোহাম্মদ আলী কাকে কল দিয়ে আসতে বলেছে, কেন বলেছে, তা বলতে পারব না।
জানতে চাইলে মিটার সেলিম বলেন, মোহাম্মদ আলী আমাকে কল দিয়ে বলেছে, ভেতরে কিছু বহিরাগত এসেছে। তখন আমরা সেখানে যাই; কিন্তু কাউকে মারধর করা হয়নি। আমরা পরে চলে এসেছি। সেখানে রাজন, নাজমুল ছিল বলেও তিনি স্বীকার করেন। কিবরিয়ার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি তার। কমিউনিটি সেন্টারেও তিনি ছিলেন না বলে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়া বলেন, আমি এসব বিষয়ে কিছুই জানি না। কেন আমাকে জড়ানো হলো তাও বুঝতে পারছি না।