মাত্র দেড় বিঘা দিয়ে শুরু হলেও এখন ৫০ বিঘা জমির মালিক বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। বছরে ৩ লাখ টাকার আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ লাখে। ১০ বছর আগেও তার অস্থাবর সম্পদের মূল্য ছিল ৮ লাখ টাকার নিচে। এখন এর মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। সে সময় স্থাবর সম্পদ ছিল মাত্র ৫ লাখ টাকার। এখন তা ৪৯ গুণ বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ নির্বাচনী হলফনামায় সব মিলিয়ে ৩ কোটি ২৯ লাখ ৪১ হাজার টাকার মালিক জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, তিনি ও তার পরিবার শতকোটি টাকার মালিক।
সূত্র বলছে, স্ত্রী মহসিনা আক্তার পেশায় গৃহিণী। তবে দুজনে এখন শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক। গত ১০ বছরে তিন দফায় এমপি হয়ে দুই হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামিয়েছেন শরিফুল। শিক্ষক নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য, টিআর-কাবিখা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে ঘুষ আদায় এবং সৌরবিদ্যুতের নামে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগে জিন্নাহকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
গত মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আশ-শামস জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন। দুদকের সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম আদালতে আবেদনে বলেন, জিন্নাহর বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের তদন্ত চলছে। তিনি যে কোনো সময় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারেন; তাই তার দেশত্যাগে বাধা দিতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।
সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় ১ কোটি ৫৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ৮৯ লাখ ২৭ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ করা হয়। ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ কমিশনের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম মামলা করেন। মামলা দুটির তদন্ত চলছে।
জিন্নাহ আওয়ামী লীগের জোট হিসেবে ২০১৪ সালে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর তার সম্পদ বেড়েছে কমপক্ষে ৪০ গুণ। তার পরিবারের সদস্যরা ফুলে ফেঁপে উঠেছে শতগুণ।
শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর সম্পদ বিবরণী ঘেঁটে দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তালিকায় ৫ কোটি ২৯ লাখ ৪১ হাজার টাকার মালিক জিন্নাহ। ১০ বছরের ব্যবধানে তার সম্পদ বেড়েছে পাঁচগুণ। স্ত্রীর সম্পদের পাহাড়ে জমা হয়েছে ২ কোটি ৬২ লাখ ৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে নগদ ও ব্যাংকে মিলেছে ২ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। স্ত্রীর ব্যাংক আমানত ও নগদ অর্থ বেড়েছে অন্তত ১৪৪ গুণ।
বর্তমানে এমপি জিন্নাহর দেড় বিঘা কৃষিজমি বেড়ে হয়েছে ৫০ বিঘা। যার মূল্য ৪৫ লাখ ৫০ হাজার ১৫০ টাকা। পিছিয়ে নেই তার স্ত্রীও। মাত্র সাত শতকের কৃষিজমি থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ বিঘা। মূল্য দেখানো হয়েছে ২৭ লাখ ১১ হাজার ৮০০ টাকা। এমপি জিন্নাহর নামে ১ কোটি ৮৯ লাখ ৬১ হাজার টাকা মূল্যের দুটি ভবন এবং ১৫ লাখ ৯২ হাজার টাকার একটি ফ্ল্যাট আছে।
তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন এই হিসাবের বাইরে শরিফুল ও তার পরিবার এখন শতকোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে একশ বিঘার ওপরে জমি রয়েছে তার।
উপজেলায় স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। জিন্নাহর হয়ে এসব দেখভাল করতেন দলের উপজেলা সভাপতি এরফান আলী। তার মাধ্যমেই হতো লেনদেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, উপজেলার একটি নামি কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগে ৩০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। কম দামে ল্যাম্পপোস্টের সৌরবিদ্যুৎ কিনে কোটি কোটি টাকার বিল করে আত্মসাৎ করা হয়েছে সরকারের টাকা। বর্তমানে বেশিরভাগ সড়কে সৌরবিদ্যুৎ অকেজো পড়ে আছে।
এ ছাড়া টিআর-কাবিখা দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোত্তালিবের ওপর। অভিযোগ আছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের জন্য টাকা বা টিআর-কাবিখার চাল ও গম দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে তা দেননি। এভাবে হাতিয়েছেন কোটি টাকা।
একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে একাডেমিক ভবন নির্মাণ করতে গেলেও জিন্নাহকে ৫ লাখ টাকা করে দিতে হয়েছে। টাকা না দিলে সেই প্রতিষ্ঠানকে ভবন দেওয়া হয়নি। এভাবে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তদন্তে এর সত্যতা পেয়েছে দুদক।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর বিরুদ্ধে তিন মামলা হয়েছে। এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে একাধিকবার তার ব্যবহৃত মোবাইলে কল করা হলে, সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।