গত ২১ নভেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) একটি লিখিত চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কাছে ৫টি পরীক্ষার ৬ ধরনের তথ্য চায়। চিঠিতে গত ৭ জুলাই রাজধানীর পল্টন থানায় করা প্রশ্নফাঁস-সংক্রান্ত একটি মামলার রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়, মামলাটির সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বাংলাদেশ কর্ম কমিশন কর্তৃক আয়োজিত উক্ত নিয়োগ পরীক্ষাগুলোর তথ্য একান্ত প্রয়োজন। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা অবধি প্রায় এক মাস হলেও পিএসসি থেকে কোনো ধরনের তথ্য সিআইডিকে দেয়া হয়নি। উল্টো সিআইডির চিঠি পাওয়ার ৪ দিন পরে ২৬ নভেম্বর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর (টেক) বা ফিজিক্যাল এডুকেশন ইন্সট্রাক্টর (দশম গ্রেড) পদে নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। এর পরদিন প্রকাশ করা হয় ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পুনঃফলাফল। প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি জানার পরে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তড়িঘড়ি করে ফল প্রকাশ করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। পিএসসির কাজ সরকারি চাকরিতে নিয়োগ-সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করা। আইন অনুযায়ী এটি সাংবিধানিক ও স্বাধীন সংস্থা। দেশের লাখো বেকারের ভাগ্যনির্ভর করে পিএসসির স্বচ্ছতার ওপরে। এবার বিসিএসের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাসহ একাধিক নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় পাওয়া গেছে খোঁদ পিএসসির একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারীর। এ ঘটনায় মামলা দায়ের হলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) কর্তৃক কয়েকজনকে আটকও করা হয়। এছাড়া পিএসসির আরও একাধিক কর্মকর্তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই বিশেষায়িত সংস্থাটির নজরদারিতে রয়েছেন বলেও জানা গেছে মামলা সংশ্লিষ্ট সূত্রে।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ৫টি পরীক্ষা নিয়ে ডাউট ছিল। আমরা সেগুলোর তথ্য-প্রমাণ চেয়েছি। তবে গত প্রায় একমাসেও পিএসসি থেকে কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ আমাদের সরবরাহ করা হয়নি। উল্টো আমরা চিঠি দেওয়ার পরেই তারা ফল প্রকাশ করে দিছে। বিষয়টি নিয়ে আমরাও বিস্মিত। চিঠি পাওয়ার পরে পিএসসির উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে অন্তত কমিউনিকেট করা; কিন্তু তারা সেটি করেনি। কেন করেনি সেটি আমার জানা নেই। আমরা তদন্ত করছি, তদন্ত শেষ হলে আদালতে আমরা প্রতিবেদন দেব। আমরা আদালতের কাছে দায়বদ্ধ। আদালতকে জানাব, আদালত পরে ব্যবস্থা নেবে।’
গত ২১ নভেম্বর সিআইডি থেকে পিএসসিকে দেওয়া চিঠির একটি কপি এসেছে কালবেলার হাতে। সেই চিঠিতে সিআইডি থেকে সিনিয়র স্টাফ নার্স, রেলের উপসহকারী প্রকৌশলী, ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি, ইন্সট্রাক্টর ও জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পরীক্ষার তথ্য চাওয়া হয়।
যেসব তথ্য চাওয়া হয়: বর্ণিত পরীক্ষাগুলোর বিপিএসসির দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউনিটের নাম এবং উক্ত ইউনিটে নিয়োজিত সব কর্মকর্তা- কর্মচারী (ক্লিনারসহ) নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর; বর্ণিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র (পাণ্ডুলিপি) মডারেশনের পরবর্তীতে বিপিএসসিতে কতদিন কার হেফাজতে ছিল এবং এ-সংক্রান্ত বিষয়ে বিপিএসসির নীতিমালা/সংরক্ষণ পদ্ধতি; বিপিএসসি হতে প্রশ্নপত্র (পাণ্ডুলিপি) কত তারিখে ছাপাখানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর; ছাপাখানা হতে বিপিএসসিতে প্রশ্নপত্র কত তারিখে গ্রহণ করে, কোন স্থানে সংরক্ষণ করা হয় এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর; ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র (পাণ্ডুলিপি) ট্রাঙ্কের চাবি সংরক্ষণের নীতিমালা/চাবির কাস্টোডিয়ান। চিঠিতে বলা হয়, মামলাটির সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বাংলাদেশ কর্ম কমিশন কর্তৃক আয়োজিত বর্ণিত পরীক্ষাগুলোর তথ্য একান্ত প্রয়োজন।
পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, সিআইডি থেকে চিঠিপ্রাপ্তির পরেই পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ৪ ঘণ্টাব্যাপী একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, এটি বাইরে চলে গেলে তারা বিপদে পড়তে পারেন। তাই যে কোনো মূল্যে দ্রুত সময়ের মধ্যে ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। এরপরই তড়িঘড়ি করে ফল প্রকাশ করে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম কালবেলাকে বলেন, ‘আসলে মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি না। আপনি আমাদের পিআরও মতিউর সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন।’ এরপর বিস্তারিত জানতে চাইলে বাংলাদেশ কর্মকমিশনে জনসংযোগ কর্মকর্তা মতিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘আসলে সার্বিক দিক বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে ফল প্রকাশ করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মিটিংয়ে তো আমি উপস্থিত ছিলাম না। আমাকে যা বলা হয়েছে তাই বলছি- সবকিছু যাচাই বাছাই করে কমিশন মনে করেছে ফলা প্রকাশ যৌক্তিক হবে, তাই এটা করা হয়েছে।’ তবে সিআইডির চিঠির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে কালবেলাকে জানান।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাদিম মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি জানার পরেও ব্যবস্থা না নিয়ে ফল প্রকাশ করা চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। এ ছাড়াও সিআইডি থেকে ২১ নভেম্বর তথ্য চাওয়া হলেও এখন প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। এক মাসেও তথ্য না দেওয়ায় তদন্ত প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে কি না, সেটিও তদন্তের দাবি রাখে। তদন্ত যত ধীরগতিতে হবে আলামত নষ্ট করার তত বেশি সময় পাওয়া যাবে।
জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, পিএসসি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তাদের আছে। তবে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি জানার পরেও তারা কেন ফল প্রকাশ করেছে সে প্রশ্নের উত্তর তারা দেবে। সিআইডিসহ দেশের যে কোনো সংস্থা তদন্তের স্বার্থে পিএসসি কাছে যে কোনো তথ্য চাইলে সেটি দেওয়ার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। না দিতে চাইলেও সেটি কেন দেয়া যাবে না তার যৌক্তিক কারণ লিখিতভাবে জানাতে হবে। সেটি না করা হলে তারা তদন্ত প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে বা তাদের কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তাদের রক্ষা করতে চাচ্ছে কি না—এ ধরনের প্রশ্ন ওঠা যৌক্তিক।