বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা চুক্তি করে বাংলাদেশ। কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো গোপনে এসব চুক্তি সম্পাদিত হয়। তবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের করা আন্তর্জাতিক এসব চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ ওঠে। কোনো কোনো চুক্তিকে দেশবিরোধী বলেও দাবি করে থাকেন সরকারবিরোধীরা। বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে করা শেখ হাসিনা সরকারের চুক্তিগুলো পর্যালোচনা এবং বাতিলেরও দাবি উঠেছে। এমন প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক চুক্তির আগে আইনসভার উভয়কক্ষের (প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষ) অনুমোদন নেওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ দিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী গত শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে চূড়ান্ত এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে আরও পাঁচটি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সরকার। তার আগে গত ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করে ছয়টি কমিশন। কমিশনগুলোর এসব প্রতিবেদন ও সুপারিশ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এ সংলাপ শুরু হচ্ছে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। এসব বিষয়ে এরই মধ্যে একটি ঐকমত্য কমিশনও গঠন করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ কমিশনের প্রধান হিসেবে সংলাপে সভাপতিত্ব করবেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে হলে সংসদের মাধ্যমে জনগণকে জানানোর বিধান রয়েছে। বর্তমান সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোন চুক্তি কেবল সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।’
সরকারের বিভিন্ন সূত্রমতে, স্বাধীনতার পর শুধু প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গেই বাংলাদেশের শতাধিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে বিএনপি সরকারের শাসনামলে ১৩টি এবং জাতীয় পার্টির শাসনামলে ছয়টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বাকি বেশিরভাগ চুক্তিই করেছে শেখ হাসিনা সরকার। এ ছাড়া চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক চুক্তি রয়েছে। তবে কখনোই সেসব চুক্তি সংসদে তেমনভাবে আলোচনা হয়নি। ফলে জনগণও এসব চুক্তির ব্যাপারে অন্ধকারে থাকে। সর্বশেষ ভারতের আদানির সঙ্গে করা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি নিয়ে বর্তমানে জোর সমালোচনা হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে এসব চুক্তিতে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে আগেই সংসদের অনুমোদন নেওয়ার কথা বলেছে সংস্কার কমিশন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৪৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের ১৪নং পৃষ্ঠায় ‘আন্তর্জাতিক চুক্তি’ অংশে বলা হয়, ‘জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এমন কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে আইনসভার উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হবে।’
আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে আইনসভার অনুমোদনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ কালবেলাকে বলেন, সংবিধানের ১৪৫ (ক)-এর মাধ্যমে কেবল বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি সংসদে উপস্থাপনের বিধান করা হয়েছে। তবে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো চুক্তি কেবল সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করার বিধান রয়েছে। ফলে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলে এমন অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি গোপনীয়তার আড়ালে সম্পাদন করা সম্ভব। সেজন্য কমিশন সুপারিশ করেছে, সব ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে উপস্থাপন করতে হবে। কমিশন আরও সুপারিশ করেছে, জাতীয় স্বার্থ বা নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলে এমন সব চুক্তি আগে সংসদ বা আইনসভায় আগেই অনুমোদন নিতে হবে।
সংস্কার কমিশনের এমন সুপারিশকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। সাবেক সচিব আবুল আলম মো. শহিদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘বহির্বিশ্বের সঙ্গে চুক্তি করতে হলে আগে নিজের দেশের আইনসভার অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন দেশে চালু রয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে ভালো প্রস্তাব। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে করা চুক্তিগুলো নিয়ে নানা কথা হয়। সেজন্য ৫৪ বছরের ইতিহাসে করা চুক্তিগুলো জনগণের সামনে প্রকাশ করা উচিত।’