এস কে দাশ সুমন, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার)
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৩২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শ্রীমঙ্গলের রাজধানী

অজপাড়া এখন পর্যটনের মডেল

অজপাড়া এখন পর্যটনের মডেল

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল। এই শহর পরিচিত ‘চায়ের রাজধানী’ হিসেবে। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সবুজে মোড়ানো শ্রীমঙ্গল এখন বছরজুড়েই পর্যটকদের পদচারণায় মুখর। চিরহরিৎ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, বিস্তীর্ণ চা-বাগান, লেবু ও কমলার বাগান—সব মিলিয়ে প্রকৃতি এখানে যেন এক অপূর্ব ক্যানভাসে তার রং ছড়িয়েছে।

এই সৌন্দর্যের বুকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শ্রীমঙ্গলের রাধানগর নামের ছোট্ট একটি গ্রাম, যেটি এখন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে চা-বাগানঘেরা এই গ্রাম এক সময় ছিল নিঃসঙ্গ, নীরব, কৃষিনির্ভর; কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় পর্যটনের ছোঁয়ায় রাধানগর আজ শুধু একটি গ্রাম নয়—এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটনের হাতছানি: রাধানগর গ্রামের অবস্থান লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কাছাকাছি হওয়ায় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যে এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সবুজে মোড়ানো উঁচু-নিচু চা-বাগান, পাশের বনাঞ্চলের পাখির কলতান, আর বাতাসে ভেসে আসা লেবুর ঘ্রাণ—সব মিলিয়ে এখানে এসে প্রকৃতির নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন যে কেউ। শুরুতে যেসব পর্যটক এখানে শুধু প্রকৃতির নির্জনতায় হারিয়ে যেতে আসতেন, তারা আজ এখানে রাতযাপন করতে চাইছেন, গড়ছেন রিসোর্ট, কটেজ, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট।

শুরুটা অবশ্য ছিল অনেকটা নিভৃত। স্বাধীনতার পর এই গ্রামে আখচাষের প্রচলন ঘটে, পরে আখচাষের জায়গা নেয় লেবু, কাঁঠাল ও অন্যান্য ফলের বাগান। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সুগন্ধি লেবুর খ্যাতি। ২০০৯-১০ সালের দিকে যখন পর্যটনের সম্ভাবনা উঁকি দিতে শুরু করে, তখন থেকেই এই গ্রাম নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্থানীয় মানুষের চেষ্টায় এবং পর্যটকদের আগমনে ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে এই গ্রামের চালচিত্র।

পর্যটনকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনের রূপান্তর:

বর্তমানে রাধানগর গ্রামে গড়ে উঠেছে ৫০টিরও বেশি রিসোর্ট, কটেজ, গেস্ট হাউস ও রেস্টুরেন্ট। এদের মধ্যে রয়েছে—নভেম ইকো রিসোর্ট, বালিশিরা রিসোর্ট, অরণ্যের দিনরাত্রি, নিসর্গ নীরব, শান্তিবাড়ি, পত্রস্নান, মাধবীলতা, লিচিবাড়ি, জলধারা, নির্জন, দহলিজ, বন্ধুর বাড়ি ইকো রিসোর্ট, হোটেল ডি-মোর, চাঁদের বাড়ি, হারমিটেজ গেস্ট হাউস ও চামুং রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড ইকো ক্যাফেসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব রিসোর্টে প্রতিদিন দেশি ও বিদেশি অন্তত ৫০০ পর্যটক রাতযাপন করেন।

পর্যটনের বিকাশ স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় এনেছে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন। আগে যারা কৃষিকাজ, দিনমজুরি বা মৌসুমি শ্রমে জড়িত ছিলেন, আজ তারা কেউ রিসোর্ট কর্মী, কেউ পর্যটক পরিবহনকারী, কেউ রেস্টুরেন্ট মালিক বা হস্তশিল্প বিক্রেতা। পর্যটন শুধু আয়ের নতুন পথই খুলে দেয়নি, তৈরি করেছে আত্মমর্যাদার নতুন পরিচয়ও।

চামুং রেস্টুরেন্টের পরিচালক তাপস দাশ বলেন, ‘প্রতিদিন পর্যটকের ভিড়ে আমাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। রেস্টুরেন্টে খাওয়া, জিপগাড়ি ভ্রমণ, আর রাতযাপনে রাধানগর এখন একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্র। এখান থেকে সরকারও রাজস্ব পাচ্ছে।’

পরিবেশবান্ধব পর্যটনের রোল মডেল:

রাধানগরের রিসোর্ট ও কটেজগুলোর স্থাপত্য ডিজাইনে পরিবেশবান্ধব নীতির প্রাধান্য রয়েছে। কাঠ ও বাঁশের ব্যবহার, প্লাস্টিকমুক্ত নীতিমালা, সোলার প্যানেলসহ স্থানীয় উপকরণ ও সংস্কৃতির সম্মিলন এখানে একটি ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে। শান্তিবাড়ি রিসোর্টের প্রতিষ্ঠাতা তানভীর লিংকন আহমেদ জানান, ‘২০১২ সালে আমি প্রথম এখানে পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট গড়ি। তখন অনেকেই সন্দিহান ছিল। আজ এখানে বিদেশিরাও থাকছেন, প্রশংসা করছেন, অনেকে নিজেরাই রিসোর্ট করছেন।’

প্রশাসনের পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:

পর্যটনের টেকসই উন্নয়নে প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশংসনীয়। শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন জানান, ‘রাধানগরে পর্যটকের সুবিধার্থে ইতোমধ্যে রাত্রিকালীন সড়কবাতির প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব ট্যুরিজম নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ চলছে। সরকারি বরাদ্দ বাড়লে এই এলাকার পর্যটন শিল্প আরও বিকশিত হবে।’

উদীয়মান ট্যুরিজম হাবের সম্ভাবনা:

রাধানগরের স্থানীয় পর্যটন উদ্যোক্তা এবং পর্যটন কল্যাণ পরিষদের সদস্য সচিব তারেকুর রহমান পাপ্পু বলেন, ‘শ্রীমঙ্গল দেশের পর্যটনের অন্যতম সম্ভাবনাময় এলাকা। কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম রাধানগরকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছে। এখানকার মানুষ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য গড়ছে। এখন দরকার শুধু সরকারি সাপোর্ট ও পর্যটন অবকাঠামো আরও শক্ত করা।’

রাধানগর আজ আর নিছক একটি গ্রাম নয়। এটি একটি জীবন্ত উদাহরণ—যেখানে পর্যটন শিল্প কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, বরং একটি অঞ্চলের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। দেশের ভেতর এমন সফল রূপান্তরের নজির খুব বেশি নেই, যেটি পরিবেশ, স্থানীয়তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে একসঙ্গে বয়ে আনে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আবারও ভারত-পাকিস্তান সেনাদের গোলাগুলি, তীব্র উত্তেজনা

মাটি কাটার দায়ে ৮ জনের কারাদণ্ড

ঢাকায় আজও বইছে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বাতাস

কলকাতার হোটেল ভয়াবহ আগুন, নিহত ১৪

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মধ্যস্থতা থেকে সরে আসার হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের

নাতনিকে ইভটিজিং, প্রতিবাদ করায় নানাকে কুপিয়ে হত্যা

বাড়িতে ঢুকে মা-বাবাকে মারধর করে মেয়েকে অপহরণ, গ্রেপ্তার ১

গাজায় আরও অর্ধশতাধিক নিহত, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা অনেকে

কেমন থাকবে আজ ঢাকার আবহাওয়া

তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতির ঘটনায় আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই : ফারুকী

১০

শেষ হয়েছে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা, ইলিশ ধরতে প্রস্তুত ভোলার জেলেরা

১১

পাট শ্রমিক দলের সভাপতি হলেন সাঈদ আল নোমান

১২

সাতক্ষীরায় বিএনপির সার্চ কমিটিতে আ.লীগ নেতারা

১৩

৩০ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৪

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৫

৩০ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৬

বিজেপি নেতার তোপে মোদি ও অমিত শাহ

১৭

ইট মারলে আমরা পাথর ছুড়ব, ভারতকে ইসহাক দার

১৮

পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী / ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানে হামলা চালাতে পারে ভারত

১৯

নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা দূর করতে হবে

২০
X