ব্যাংকবহির্ভূত কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন মৃতপ্রায়। প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে যেমন আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছে না, তেমনি নতুন আমানত সংগ্রহেও ব্যর্থ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এই খাতকে বাঁচাতে ধাপে ধাপে মোট ২২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের চিন্তাভাবনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথম ধাপে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা ১১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ঋণের বড় অংশ অনাদায়ি হয়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে দেশের মোট ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১টির বিতরণ করা ঋণের ৭৫ থেকে ৯৯ শতাংশই খেলাপি। এর মধ্যে পাঁচ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৯৫ শতাংশের বেশি। আর মোট ঋণের অর্ধেক বা এর বেশি খেলাপি ২২ প্রতিষ্ঠানের। সব মিলিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের ব্যাংক খাত লুট হয়। একই সময়ে লুট হয় দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও (এনবিএফআই)। এর মধ্যে পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আভিভা ফাইন্যান্সসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট করে পি কে হালদার ও চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ এস আলম। এজন্য সরকার পরিবর্তনের পর ২৪টি ব্যাংক ও ২২ আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম ধাপে ব্যাংক খাত সংস্কারে হাত দেয়। এখন নতুন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে আদালতের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক আভিভা ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্সসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে। এ ছাড়া লুটপাট হওয়া খারাপ প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্ষদও ধীরে ধীরে পুনর্গঠন করে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলেছি। এই খাতকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কারের আওতায় আনা হবে। একই সঙ্গে দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে। এজন্য গভর্নর স্যারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হচ্ছে। আশা করি দ্রুতই কোনো সিদ্ধান্তের মধ্যে আমরা যেতে পারব।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই রুগন। বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে হাইকোর্টের আদেশে তা আটকে গেছে। এখন নতুন আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করা হবে, অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের মালিকানায় নিয়ে পুনর্গঠন করা হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের তুলনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থান খুবই নগণ্য। এজন্য আমরা আগে ব্যাংক খাত সংস্কার করব। এরপর এনবিএফআইগুলোর দিকে নজর দেওয়া হবে। তবে এখনো এনবিএফআইগুলোর সংস্কারে কাজ চলমান আছে। ধীরে ধীরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থার উন্নতি হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকজন নির্বাহী পরিচালক বলেন, সংখ্যার দিক থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ হলেও এই খাতের সম্মিলিত খেলাপি এখনো ৩৫-৩৬ শতাংশ। সে হিসাবে ব্যাংক খাতের অবস্থা থেকে এই খাতের অবস্থা ভালো। অর্থাৎ যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট হয়েছে সেগুলো এই খাতের ছোট প্রতিষ্ঠান। বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো ভালো আছে। তাই একীভূত করাসহ কয়েকটি পদক্ষেপ নিলেই এই খাত দ্রুত দাঁড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। গত জুন শেষে এই খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ডিসেম্বরের শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ের মোট ঋণের ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এফএএস ফাইন্যান্সের ১ হাজার ৮২২ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৮২০ কোটি টাকাই এখন খেলাপি। এর মানে প্রতিষ্ঠানটির ৯৯ দশমিক ৯২ শতাংশ ঋণই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। একইভাবে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৮৯০ কোটি টাকা ঋণের ৯৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, বিআইএফসির ৭৭৩ কোটি টাকা ঋণের ৯৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, পিপলস লিজিংয়ের ১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা ঋণের ৯৭ শতাংশ এখন খেলাপি। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৪ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৯৬ দশমিক ১৯ শতাংশ অর্থাৎ ৩ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণের ৯৪ দশমিক ৬০ শতাংশ, আভিভা ফাইন্যান্সের ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা ঋণের ৮৯ দশমিক ৮১ শতাংশ এখন খেলাপি। এ ছাড়া ফিনিক্স ফাইন্যান্সের মোট ঋণের ৮৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের মোট ঋণের ৮৭ দশমিক ৮২ শতাংশ, প্রাইম ফাইন্যান্স মোট ঋণের ৭৭ দশমিক ৬২ এবং প্রিমিয়ার লিজিংয়ের মোট ঋণের ৭৫ দশমিক ২০ শতাংশ এখন খেলাপি।
মোট ঋণের অর্ধেক বা এর বেশি খেলাপির তালিকায় থাকা আইআইডিএফসির ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, বে লিজিংয়ের ৬৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের ৬৩ দশমিক শূন্য ৩, সিভিসি ফাইন্যান্সের ৫৯ দশমিক ৫৪, জিএসপি ফাইন্যান্সের ৫৮ দশমিক ২৪, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৬৯ এবং উত্তরা ফাইন্যান্স ৫৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ১৩টির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের খেলাপি ঋণ তুলনামূলক কম। যে কারণে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সার্বিকভাবে এ খাতের ৭৩ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ২৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন উচ্চ সুদ দিয়েও আমানত পাচ্ছে না। গত নভেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ সুদে আমানত নিয়েছে। আর ঋণের গড় সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর পরও আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না। ফলে নতুন ঋণ বিতরণও তেমন হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই কোনোমতে টিকে আছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ কমে ৪৭ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকায় নেমেছে, যা গত জুন শেষে ছিল ৪৭ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। একইভাবে ঋণস্থিতি কমে গত সেপ্টেম্বর শেষে ৭৩ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকায় নেমেছে, যা তিন মাস আগে ছিল ৭৪ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ত্রৈমাসিকের সুদ যোগ করে আমানত ও ঋণ স্থিতির হিসাব হয়। ফলে নিট ঋণ ও আমানত কমেছে অনেক বেশি।
আর্থিক খাতের সংকটের কারণ জানতে চাইলে বিশিষ্ট ব্যাংকার মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, ‘ব্যাংকের পর আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্দেশ্য ছিল আলাদা; কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের মতো পণ্য নিয়ে একই গ্রাহকের পেছনে ছুটেছে। তাদের দক্ষতা বা সক্ষমতা না থাকায় পিছিয়ে পড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে এত ব্যাংকের পর ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সেটি কখনো পর্যালোচনা করা হয়নি। বরং রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে খাতটিকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে পারে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’
মন্তব্য করুন