মৃত্যুর আগে নিজের ছেলেকে দেখে যাওয়ার আকুতি জানালেন ‘নিখোঁজ’ সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন। আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে গতকাল বুধবার রাজধানীর আইডিইবি মিলনায়তনে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘এত বছর হয়ে গেছে ছেলের কোনো খোঁজ পাইনি। দুই নাতনি নিয়ে বেঁচে আছি। আমার একটাই চাওয়া, মরার আগে যেন ছেলেকে দেখে যেতে পারি।’
শুধু হাজেরা খাতুন নন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এভাবেই তাদের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন দীর্ঘদিন ধরে ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের কারও সন্তান, কারও স্ত্রী, মা, কিংবা পরিবারের সদস্যরা।
তাদের দাবি, চোখের পানি আর রক্তাক্ত মুখের আর্তনাদ ফেরাতে পারেনি সন্তানকে। বৃদ্ধ বাবার কান্না খুঁজে পায়নি সন্তানকে। স্বামী হারানো স্ত্রীর দুঃখভরা মন জবাব খুঁজে পায় না সন্তানের প্রশ্নের। সন্তান বাবার খোঁজে পার করেছে অসংখ্য রাত। সবারই একটাই প্রার্থনা—তাদের পরিবারের সদস্যদের যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
২০১৪ সালে নিখোঁজ হওয়া চঞ্চল হোসেনের ১০ বছর বয়সী ছেলে আহাদ হোসেন বলেন, ‘বন্ধুরা যখন জিজ্ঞেস করে, তোমার বাবা কোথায়—আমি বলি, বিদেশে।’
একই বছর নিখোঁজ হওয়া মফিজুল ইসলামের ছেলে সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাবা গুম হওয়ার তিন মাস পর মা আইন ও সালিশ কেন্দ্রে যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। যখন মায়ের লাশ আনতে যাই, তখন থানায় বাবা মৃত লিখে মায়ের লাশ নিয়ে আসতে হয়েছে।’ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সহিদুল বলেন, ‘কথা না বললে আজ আমরা কাঁদছি, কাল আপনারাও কাঁদবেন।’
খিলগাঁওয়ে গুলিতে নিহত নুরুজ্জামান জনির বাবা ইয়াকুব আলী বলেন, ‘একটা মানুষকে খুন করতে কয়টা গুলি লাগে? আমার জনিকে ওরা ১৮টা গুলি করেছিল।’ ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকার মিরপুর থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন মিরাজ খান। এর চার মাস পর চট্টগ্রাম ঈদগাহ এলাকা থেকে মিরাজের ভাই ফিরোজ খানকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ফিরোজ খানের স্ত্রী আমেনা আক্তার বৃষ্টি বলেন, ‘গত ১১টা বছর সেলাইয়ের কাজ করে ছেলেকে নিয়ে কোনো রকম বেঁচে আছি।’
অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এই সরকার যত দিন আছে তত দিন গুম হয়ে যাওয়া মানুষের কোনো খোঁজ পাওয়া যাবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘ভিন্ন মতের মানুষের মধ্যে ভয় সৃষ্টির জন্য গুম করা হচ্ছে। এসব গুমের বিচার যারা করছেন না, তাদেরও বিচার হবে। দেশে না হলেও আন্তর্জাতিক আদালতে হবে ‘
তিনি বলেন, ‘যদি আমরা গুমের বিচার চাই, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই—তাহলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা কোনো প্রতিশোধের রাজনীতি করি না। কিন্তু যারা খুনি ডাকাত এবং প্রতিটি গুমের জন্য দায়ী তাদের বিচার করা হবে।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘এই সরকার টিকে থাকলে আরও গুম-খুন করবে। যারা এখন নিজেদের নিরাপদ ভাবছেন তাদের ঘরেও হাত যাবে। গুম-খুন করে তারা ভয় দেখাতে চায়। এই ভয়কে অকার্যকর করতে পারলে একদিনেই এই সরকারের পতন সম্ভব।’
গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘আগামী দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। তাই বিরোধী দলের যারা রাজপথে আন্দোলন করছেন তাদের এক থাকতে হবে। হয় লড়ো, না হয় মরো।’
হাজেরা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, জেএসডির তানিয়া রব, মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলি প্রমুখ। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশনের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন