নুর মোহাম্মদ
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৬ জুন ২০২৫, ০৮:১৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মতিঝিল আইডিয়ালে শিক্ষকদের রেষারেষির বলি শিশু শিক্ষার্থীরা

আতঙ্কিত অভিভাবকরা চান সরকারের হস্তক্ষেপ
মতিঝিল আইডিয়ালে শিক্ষকদের রেষারেষির বলি শিশু শিক্ষার্থীরা

রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও রেষারেষির মাঝে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকরা তাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বা প্রতিযোগিতাকে নিয়ে আসছেন শ্রেণিকক্ষে, যার সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। এরই ধারাবাহিকতায় এবার এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে সহকর্মীকে ফাঁসাতে ভয়ভীতি দেখিয়ে ছাত্রদের দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ লেখানোর অভিযোগ উঠেছে। যার জেরে তিন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকে বেশ কিছুদিন। ভুক্তভোগী অভিভাবকরা বলছেন, এ ঘটনায় তারা প্রতিকার চেয়ে লিখিত অভিযোগ করলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, উল্টো যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকেই রক্ষার চেষ্টা চলছে।

জানা গেছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের মুগদা শাখায় এমন ঘটনা ঘটেছে। গত ১৩ মে স্কুল ছুটির পর ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক শফিকুল ইসলাম খান সপ্তম শ্রেণির তিন ছাত্রকে একটি কক্ষে আটকে রেখে বাংলার শিক্ষক হাদিউজ্জামানের বিরুদ্ধে জোর করে লিখিত অভিযোগ আদায় করেন। এ ঘটনার পর আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়ে ওই তিন শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে একজনের জ্বরের মাত্রা চড়ে ১০৩ ডিগ্রিতে। ঘটনার পর প্রথম কিছুদিন ভয়ে স্কুলে যায়নি ওই তিন শিশু শিক্ষার্থী। তারা এখনো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা। শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে জড়ানোর এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করেন অভিভাবকরা। কিন্তু এক মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতিকার তো দূরের কথা, কোনো তদন্ত কমিটি পর্যন্ত করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের সন্তানদের নিরাপত্তা ও যথাযথ মানসিক বিকাশ নিয়ে আতঙ্কে আছেন অভিভাবকরা।

তাদের অভিযোগ, যৌন হয়রানির অভিযোগে শিক্ষক শফিকুলের বিরুদ্ধে গত এপ্রিল মাসে মামলা করেন তারই এক নারী সহকর্মী। এ নিয়ে তৈরি একটি ভিডিও ক্লিপ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। শফিকুলের ধারণা, ওই ভিডিও ক্লিপ তৈরির নেপথ্যে কিছু শিক্ষকের ইন্ধন রয়েছে। এমন ভাবনা থেকে হাদিউজ্জামানকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করেন তিনি এবং ছাত্রদের দিয়ে জোর করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করান।

ভুক্তভোগী অভিভাবকদের একজন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে কর্মরত সাবিনা ইয়াসমীন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, স্কুল ছুটির পর শিক্ষক শফিকুল ইসলাম খান তার সন্তানকে ৪০৬ নম্বর রুম থেকে ৪০২ নম্বর রুমে ডেকে নেন। সেখানে আটকে রেখে জোর করে আরেক শিক্ষক হাদিউজ্জামানের বিরুদ্ধে নিজের হাতে লেখা একটি অভিযোগের কপি তার সন্তানকে দিয়ে জোর করে লেখানো হয়। সাবিনা ইয়াসমীন কালবেলাকে বলেন, ‘বাসায় ফিরে ছেলে ভয়ে কাঁপতে থাকার কারণ জানতে চাইলে একপর্যায়ে সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘শফিক স্যার জোর করে আমাকে দিয়ে হাদি স্যারের বিরুদ্ধে লিখিত নিয়েছেন। আমি লিখতে না চাইলে স্যার বললেন, ভয় নেই, কেউ জানবে না। হাদি স্যার জানবে না, তোমার আব্বা-আম্মাও জানবে না।’

এ ঘটনার পর প্রতিকার চেয়ে স্কুলের অধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন জানিয়ে ইয়াসমীন বলেন, ‘কেন একজন শিশু বাচ্চাকে এমন বিষয়ে জড়ানো হলো? আমার সন্তান এর পর থেকে স্কুলে যেতে চাইছে না এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কান্নাকাটি করছে। আমি নিজেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।’

ভুক্তভোগী বাকি দুই অভিভাবকও একই ধরনের অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেলেও তাদের সন্তানরা এখনো মানসিকভাবে স্বাভাবিক হয়নি। এ ছাড়া কোনো তদন্ত কমিটি গঠন বা শিক্ষক শফিক খানকে ডেকে এ বিষয়ে জানতে পর্যন্ত চাওয়া হয়নি। উল্টো তাকে রক্ষার চেষ্টা করছেন অধ্যক্ষ।

জানা গেছে, গত ১৬ এপ্রিল ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের মুগদা শাখার ইংরেজি মাধ্যমের এক শিক্ষিকা শফিক খান ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ফেরদাউসের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে মামলা করেন। আর এর পরপরই চারটি ঘটনা ঘটেছে। নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া শফিকুল যাকে সন্দেহ করছেন, তাকেই ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। আর নানাভাবে তাকে সহযোগিতা করছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ— এমনই অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।

শিক্ষিকার করা যৌন হয়রানির মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়, শফিকুল ইসলামের মেয়ে মুগদা শাখার ছাত্রী। সহকর্মী ও ছাত্রীর বাবা হিসেবে তার সঙ্গে পরিচয় ওই শিক্ষিকার। শফিক বিভিন্ন সময় নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতেন। শিক্ষিকা এখনো কেন বিয়ে করেননি, তা নিয়েও বিরূপ আচরণ করতেন। প্রথম ঘটনা ঘটে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি। শিক্ষিকার হাতে থাকা ডাস্টার ও কলম ফেলে দেন শফিকুল। শিক্ষিকা তা ওঠাতে গেলে তার শরীরে হাত দেন তিনি। এ ঘটনা স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানালে হত্যার হুমকি আসে শফিকুলের কাছ থেকে। পরে ৯ এপ্রিল শিক্ষিকার রুমে জোর করে ঢুকে উচ্চ স্বরে গালাগাল করে শফিক বলেন, সপ্তম শ্রেণির ক্লাস টিচার কে? তার এত বড় সাহস! প্রতিদিন আমার মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়। পরে এ নিয়ে কথা বলার জন্য শফিকুল, শিক্ষিকা ও অন্যদের সঙ্গে বসেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। তবে সেখানে পাশের চেয়ারে বসে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ উল্টো শিক্ষিকাকে যৌন হয়রানি করেন বলে মামলায় উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া ওই শিক্ষিকার অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা তার বিরুদ্ধে মেয়েদের ক্লাসে হিজাব পরতে না দেওয়ার অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়।

প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শিক্ষক কালবেলাকে বলেন, এই যৌন হয়রানির ঘটনায় তৈরি একটি ভিডিও ক্লিপ ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি একটি কোচিং সেন্টারে সেই ভিডিও ক্লিপের লিংক বাংলার শিক্ষক হাদিউজ্জামানকে পাঠায় এক ছাত্র। এ বিষয়টি শফিকুল ইসলাম খানের কানে পৌঁছানোর পর তিনি হাদিউজ্জামানের বিরুদ্ধে ওই তিন ছাত্রকে দিয়ে জোর করে অভিযোগ লেখান। এই অভিযোগ অধ্যক্ষের কাছে জমা দেওয়ার এক দিন পরই তিনজন অভিভাবক ও হাদিউজ্জামান পাল্টা অভিযোগ করেন অধ্যক্ষের কাছে এবং শফিকুল কীভাবে শিশু শিক্ষার্থীদের দিয়ে জোর করে অভিযোগ লিখিয়েছেন তার প্রমাণসহ জমা দেন।

জানা গেছে, চালককে দিয়ে গাড়ির তেল বাবদ দেড় লাখ টাকা উত্তোলন, ভাইবোন কোটায় ভর্তি বাণিজ্য এবং প্রায় ৪০০ শিক্ষক নিয়োগ ইস্যুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এসব অনিয়মের অভিযোগ তুলে মামলা করেছেন একজন অভিভাবক।

মামলাটির বাদী সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আমার সন্তান এই প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে। দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মান দিন দিন তলানিতে যাচ্ছে। নিজের দায়বদ্ধতা থেকে মামলাটি করেছি, যা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে।’

এ বিষয়ে হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ওনার (শিক্ষক শফিকুল) সঙ্গে আমার কোনোদিন বিরোধ হয়নি। কিছুদিন আগে তার স্ত্রীর জন্য আমি রক্ত দিয়েছি। অথচ উনি মিথ্যা একটি অভিযোগ শিক্ষার্থীদের দিয়ে করালেন।’

আর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ফেরদাউস কালবেলাকে বলেন, ‘দুজন শিক্ষক ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা অভিযোগ আমার কাছে এসেছে। বিষয়টি গভর্নিং বডির সভাপতিকে জানানো হয়েছে।’

শিশু শিক্ষার্থীদের দিয়ে জোর করে অভিযোগ লেখানোর বিষয়ে মোবাইল ফোনে কল করে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয় শিক্ষক শফিকুল ইসলাম খানের। তবে তিনি বিস্তারিত শোনার পর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর ফের একাধিকবার কল করা হলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।

মুগদা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জানান, ঘটনাটি তদন্তের জন্য মূল শাখা বা অধ্যক্ষের কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা পাননি।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান জিয়াউল কবির দুলু কালবেলাকে বলেন, ‘আইডিয়াল স্কুলে গাড়ির তেল সিন্ডিকেটসহ অ্যাডহক কমিটি আগের মতোই লুটপাট অব্যাহত রেখেছে। শুধু ব্যক্তি পরিবর্তন হয়েছে, সিস্টেমের বদল হয়নি। শিক্ষক দ্বারা ছাত্রীদের হয়রানি চলছে। প্রতিবাদ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অবৈধ খাত তৈরি করে শিক্ষক-কর্মচারীদের নামে উৎসাহ ভাতা দিয়ে স্কুল ফান্ডের প্রায় ২ কোটি টাকা গত কয়েক মাসে ভাগবাটোয়ারা করেছে বর্তমান কর্তৃপক্ষ। বদলি বাণিজ্যও চলছে।’ এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তিনি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শান্তির ডাকে যুদ্ধ আরও জটিল রূপ নিচ্ছে না তো?

ট্রাম্পের হম্বিতম্বির নেপথ্যে কী

নতুন দায়িত্ব নেওয়া ইরানি ড্রোন কমান্ডারকেও মেরে ফেলল ইসরায়েল

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মতুয়া সম্প্রদায়ের পাশে পূজা উদযাপন পরিষদ

ময়মনসিংহে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১১

থানায় রক্ষিত বাক্স ভেঙে বের করা হয় এইচএসসির প্রশ্নপত্র

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত / ৫৭ দেশের সহস্রাধিক মুসলিম নেতা বৈঠকে বসছেন আজ

নতুনবাজার অবরোধ করলেন ইউআইইউর শিক্ষার্থীরা

ছাত্রাবাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

ইরানের ভূকম্পন কি গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা?

১০

দিনে কতবার প্রস্রাব হওয়া স্বাভাবিক? কিডনি সমস্যার লক্ষণ নয়তো

১১

ইরানের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের পরস্পরবিরোধী বার্তা

১২

‘চা-নাশতার’ খরচে মিলছে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি

১৩

তুরস্কে গেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১৪

‘পুরো বিশ্বের সামনে ইসরায়েলকে নত করাবে ইরানের বাহিনী’

১৫

ইরান বলছে কূটনীতির দরজা খোলা, ইসরায়েল জানাল হামলা চলবে

১৬

ঢাকায় বৃষ্টি হলে বাড়বে তাপমাত্রা

১৭

সেপটিক ট্যাংক থেকে দুই শিশুর মরদেহ উদ্ধার 

১৮

আগে বিচার ও সংস্কার পরে নির্বাচন : মুজিবুর রহমান

১৯

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

২০
X