দশম কেন্দ্রীয় জাতীয় সম্মেলন ঘিরে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) চলছে টানাপোড়েন। নীতিনির্ধারকদের মধ্য বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা, যার ফলে ফাটল স্পষ্ট হয়েছে এবং পুনরায় বিভক্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সম্মেলন প্রস্তুতির জন্য কোনো কমিটি না হলেও একটি পক্ষ দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরকে ছাড়াই আয়োজন চলমান রেখেছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২৮ জুন দশম সম্মেলনের ঘোষণা দেয় জাপা; কিন্তু কর্তৃপক্ষ জাপার হল বরাদ্দ বাতিল করায় নতুন প্রাপ্তি সাপেক্ষে সম্মেলন অনুষ্ঠানের পরবর্তী সময়ে নির্ধারণ করা হবে বলে গত সোমবার দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়। আর এ বিষয়টি নিয়েই দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বে মনোমালিন্য শুরু হয়। দলীয় চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে জাতীয় সম্মেলন স্থগিতের বিষয়টিকে নেতিবাচক ও অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করছেন। সম্মেলন যথাসময়ে বিকল্প স্থানে অনুষ্ঠান ও গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে পক্ষ ও বিপক্ষ। আর এ নিয়ে আবার দলের ভেতর থেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি অংশ তাকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর তৎপরতায় যুক্ত হয়েছে। সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য একটি পক্ষের দৃঢ় অবস্থান থাকায় জাপায় ফাটলরেখা স্পষ্ট হয়েছে। এ পক্ষটি দল ছেড়ে গিয়ে নয়, বরং সম্মেলনের মাধ্যমে জাপায় পরিবর্তন আনতে চান। এ পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন দলের কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার।
এ বিষয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, চেয়ারম্যান একক সিদ্ধান্ত সম্মেলন স্থগিত করতে পারেন না। দলের প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত ছিল এ ভেন্যুতে সম্মেলন না করা গেলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বা তার আশপাশে কোথাও হবে। আমরা সম্মেলন করার পক্ষে বিকল্প ভেন্যু খুঁজছি। একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বের হয়ে দলে গণতন্ত্রায়ন করতে চাই। আর সম্মেলনে কে আসবে কে আসবে না, সেটা তাদের বিষয়, আমরা দলের সম্মেলন নির্ধারিত দিনেই দলীয় কার্যালয়ের সামনে করব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কেন দল ছেড়ে যাব, দলের সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচিত নেতৃত্বের হাতেই দল পরিচালিত হবে।
এদিকে জাতীয় সম্মেলন নিয়ে চেয়ারম্যানপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতারা দলের এই তৎপরতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা নেতাদের সঙ্গে কোনোভাবেই আপস করবে না তারা। তারা বলছেন, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব দলের তৃণমূলও গ্রহণ করবে না। এরকম চেষ্টা এর আগে বহুবার হয়েছে; কিন্তু তারা বিলীন হয়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলীয় প্রেসিডিয়াম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র এবং বিকল্প হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় সম্মেলন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে। চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের বরাদ্দ বাতিল করে দেওয়ায় দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে সম্মেলন স্থগিতের বিষয়ে অবগত করেন। সম্মেলন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা থাকায় নির্বাচন কমিশনকে চিঠিতে পরবর্তী সম্মেলনের স্থান ও সময় জানিয়ে দেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করে। এতেই দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের অনেকে নাখোশ হয়েছেন। তাদের দাবি দলের প্রেসিডিয়াম বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থান বরাদ্দ বাতিল হলে একই দিন বিকল্প ভেন্যুতে সম্মেলন হবার কথা। সম্মেলন স্থগিত করতে যদি হয়ও, সেটা প্রেসিডিয়াম সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতেই করতে হবে। একক সিদ্ধান্ত নেওয়াকে দলের নীতিনির্ধারকরা অগণতান্ত্রিক হিসেবে আখ্যায়িত করছেন।
সূত্র জানায়, দলের চেয়ারম্যান তার একক সিদ্ধান্তে চিঠি দিয়ে দল থেকে বহিষ্কার, কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার প্রবণতার মতো অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধেও কথা বলছেন নীতিনির্ধারকরা। তারা বলেছেন, সম্মেলনে গঠনতন্ত্রের ধারা-২০-এর (ক) উপধারাটিতে সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া হবে, যেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান যে কোনো পদে যে কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ, অপসারণ ও তার স্থলাভিসিক্ত করার এখতিয়ার খর্ব হয়। এই অগণতান্ত্রিক ধারা সংশোধন ও দলের সম্মেলনে গণতান্ত্রিক উপায়ে নেতৃত্ব বাছাইয়ের পক্ষে কথা বলছেন তারা।
জি এম কাদের অনুসারী দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ বলেন, আসন্ন জাতীয় সম্মেলনের স্থান বরাদ্দ বাতিল হওয়ায় দল সম্মেলন স্থগিত করেছে। কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা চেয়ারম্যানের বিরোধিতা করেন। এদের কেউ কেউ দল ভেঙে বেরিয়ে যাওয়াদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চান। জাতীয় পার্টিতে পারিবারিক নেতৃত্বের বিকল্প নেই। যে মন কষাকষি আছে, তা ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া যারা সম্মেলন করতে চান, অথচ সম্মেলন প্রস্তুতির জন্য কোনো কমিটিই তো হয়নি। দলের চেয়ারম্যান ছাড়া কজন মিলে বসলেই সম্মেলন হয়ে যাবে?
জাপার আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী কালবেলাকে বলেন, অনেক কিছুই শুনছি। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কারও কারও মনে দুঃখ-কষ্ট রয়েছে। কিছু সিদ্ধান্তে তৈরি হয়েছে উষ্মা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এমনিতেই আমরা বিপদে আছি, আশা করি ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন