রাজধানীর এমন কোনো রাস্তা নেই যে, ব্যাটারিচালিত রিকশা দখল করে রাখেনি। দেখে মনে হবে এটিই ঢাকার প্রধান পরিবহন। ব্যস্ততম সব সড়কেই যানজটের মূল কারণ তিন চাকার এই যান। ব্যাটারিচালিত রিকশা ট্রাফিক ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে ফেলছে। সড়কে মহামারি রূপ নিয়েছে নিষিদ্ধ এসব ব্যাটারি রিকশা। এসব নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এমনকি ঢাকাসহ সারা দেশে কী পরিমাণ ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যানও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা সংস্থার নেই। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যাটারিচালিত রিকশা দায়ী।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন কালবেলাকে বলেন, এমন একটি যান ঢাকা শহরে চলার কোনো কারণ দেখি না। ব্যাটারি রিকশা ঢাকার মতো বড় শহরে চলার অনুমতি দেওয়া ঠিক হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমতি না দিলেও একটা মৌন সম্মতি কর্তৃপক্ষের রয়েছে, তা না হলে তো এসব রিকশা চলতে পারত না।
শুরুটা হয় চাঁদার জোরে: অনুমোদনহীন এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা মূলত চাঁদা দিয়ে চলাচল শুরু করে। এলাকাভেদে প্রতিটি রিকশাকে মাসে চাঁদা দিতে হয় এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। অবৈধ এই চাঁদা আদায়ের বৈধতা তৈরিতে চালু করা হয় ‘কার্ড সিস্টেম’। চাঁদার এই টাকা পুলিশ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা এবং শ্রমিক নেতারা ভাগবাটোয়ারা করে নেন।
একটি অসমর্থিত সূত্র বলছে, রাজধানীতে
প্রায় ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। এলাকাভেদে মাসের চাঁদার অঙ্ক আলাদা ছিল। যেমন—কামরাঙ্গীরচর এলাকায় তিন হাজার টাকা, তেজগাঁও এলাকায় আড়াই হাজার টাকা, যাত্রাবাড়ী এলাকায় এক হাজার ২০০ টাকা এবং মিরপুর এলাকায় দিতে হয় এক হাজার টাকা চাঁদা।
চাঁদা আদায়ে শৃঙ্খলা রাখতে ব্যবহার করা হতো নির্দিষ্ট প্রতীকের কার্ড। যেমন—আপেল, ইলিশ, বাঘ, আম ইত্যাদি। কার্ড দিয়েই নির্ধারণ করা হতো এলাকাভিত্তিক চাঁদার হার। আবার রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে প্রতি ব্যাটারিতে গ্যারেজ মালিকরা আলাদা করে নেন ৩৫ থেকে ৫৫ টাকা।
এখন অবশ্য আর আগের মতো নিয়মিত চাঁদা দিতে হচ্ছে না বলে কালবেলাকে জানিয়েছেন রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখন আগের মতো চাঁদা দিতে হয় না। তবে নতুন করে আবার কিছু জায়গায় চাঁদা চাওয়া হচ্ছে বলে খোঁজ পাচ্ছি।
ভয়াবহ রূপ নেয় গত জুলাইয়ে: ২০২৪ সালের জুলাই শিক্ষার্থীরা যখন কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করে, তখন বেশিরভাগ সড়কে স্বাভাবিক যান চলাচল ব্যাহত হয়। বাসসহ অন্যান্য যানবাহন ‘কমপ্লিট শাটডাউনে’ চলাচল করতে পারেনি। তা ছাড়া বিভিন্ন সড়ক অবরোধের কারণেও গণপরিবহনের চলাচল সীমিত হয়ে আসে। ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।
এরপর আগস্ট মাসে উড়াল সড়ক, উড়াল মহাসড়ক ও বিমানবন্দরেও ব্যাটারি রিকশা চলতে দেখা গেছে। লাখের নিচে থাকা ব্যাটারি রিকশা ১০ লাখ ছুঁয়েছে। পাড়া-মহল্লার গলি থেকে বেড়িয়ে এসেছে প্রধান সড়কে। তারপর এসব অবৈধ যানকে আর গলিতে ফেরানো যায়নি।
যদিও বুয়েট একটি নিরাপদ রিকশার মডেল তৈরি করেছে। এটিকে আবার লুটপাটের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন রিকশাচালক ইউনিয়নের নেতারা। শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, এই সরকারের মেয়াদ আর বেশিদিন নেই। শেষ মুহূর্তে লুটপাটের হাতিয়ার হিসেবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে রাজধানীসহ দেশজুড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা কত তার হিসাব নেই সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে। এমন পরিস্থিতিতে এসব যান নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। এসব যান চলাচলে প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরির কথা বলা হচ্ছে। কারণ বিদ্যমান নীতিমালায় অনিরাপদ তিন চাকার যান চলাচলের সুযোগ নেই।
গত বছরের ১৫ মে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) উপদেষ্টা পরিষদের সভা থেকে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সেটি কার্যকর করা যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারও এসব যান বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
অনুমতি দেবে কোন সংস্থা: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা এক লাখ ৮২ হাজার ৬৩০টি। উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ২৮ হাজার ১৫২টি। নিবন্ধিত দুই লাখ ১০ হাজার ৭০০ রিকশার সবই প্যাডেলচালিত। এর বাইরে রাজধানীতে সব রিকশাই অনিবন্ধিত। ঢাকা শহরে ব্যাটারি রিকশার সংখ্যা ঠিক কত, সেই হিসাব পাওয়া কঠিন।
সাধারণত দেশজুড়ে যান্ত্রিক যান চলাচলের অনুমতি দেয় বিআরটিএ। আর অঞ্চলভিত্তিক ছোট যান চলাচলের অনুমতি দেয় আঞ্চলিক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (আরটিসি)। রাজধানীতে পদাধিকারবলে এই কমিটির প্রধান পুলিশ কমিশনার। আর রাজধানীর বাইরে জেলা প্রশাসক কমিটির প্রধান হিসেবে যান চলাচলের অনুমতি দেন। আবার অযান্ত্রিক যান চলাচলের অনুমতি দেয় সিটি করপোরেশন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে বর্তমানে প্রায় আড়াই লাখ অযান্ত্রিক যান চলাচল করছে। যদিও ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক চলাচলের অনুমতি হাইকোর্টের নির্দেশে বন্ধ রয়েছে। বিআরটিএও এসব যানের নিবন্ধন দেয় না।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি কোন প্রতিষ্ঠান দেবে, তা পরিষ্কার নয়। কারণ যে প্রতিষ্ঠান এসব যান চলাচলের অনুমোদন দেবে ওই প্রতিষ্ঠানকেই রুট পারমিট, সংখ্যাগত ও পরিমাণগত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিতে হবে।
জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, এ জাতীয় যানের অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ কোনোটাই বিআরটিএর হাতে নেই। তবে সড়ক নিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ যানের নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
ব্যাটারিচালিত রিকশা কি বৈদ্যুতিক যানের স্বীকৃতি পাচ্ছে: যানবাহনে জ্বালানি তেলের পরিবর্তে বিদ্যুৎনির্ভর ব্যাটারির ব্যবহারকে বৈদ্যুতিক মোটরযানের আওতায় এনে পরিচালনা করার পরিকল্পনা করা হয়। এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু ওই নীতিমালায় রিকশার মতো তিন চাকার বাহনের উল্লেখ না থাকায় রিকশার জন্য আলাদা নীতিমালা করার কথা ভাবা হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে কি রিকশা বৈদ্যুতিক যানের স্বীকৃতি পাবে? কারণ নীতিমালা হলে এর ধরন, চলাচলের সীমানা, চার্জিং স্টেশন, গতিসীমা, যানের অনুমোদন, চালকের লাইসেন্স—সব কিছুই নির্ধারণ করা হবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক শামছুল হক কালবেলাকে বলেন, ব্যাটারি রিকশার নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতিমালা জরুরি। একটা আইন থাকলে নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হবে। আর বৈধ অনুমোদনের জন্য নতুন নকশা হয়েছে।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে বৈদ্যুতিক যান চলাচল সংক্রান্ত মোটরযানের নীতিমালা অনুমোদন করা হয়। বৈদ্যুতিক যেসব যান বর্তমানে সড়কে চলাচল করছে, সেগুলোকে একটি নির্দিষ্ট নিরাপদ মডেলে রূপান্তর করতে হবে। বৈদ্যুতিক মোটরযান নিবন্ধন ও চলাচল সংক্রান্ত নীতিমালায় এমন বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
নীতিমালার তৃতীয় অধ্যায়ের ১২-এর ৮ ধারায় বলা হচ্ছে, বিদ্যমান অনিরাপদ ইলেকট্রিক মোটরযান কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিরাপদ মডেল অনুসরণ করে রূপান্তর করতে হবে। অন্যথায় চলাচল করতে পারবে না।
অবৈধ যানের নির্মাণ থেমে নেই: ব্যাটারিচালিত রিকশার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এই অবৈধ বাহনটি নির্মাণ ও সংযোজন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে পুরান ঢাকা, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছোট ছোট ওয়ার্কশপে ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি ও রূপান্তর করা হচ্ছে।
কামরাঙ্গীরচর এলাকার একটি কারখানার কারিগর জয়লান মিয়া (ছদ্মনাম) জানান, ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ করে একটি রিকশা তৈরি করা যায়। চাহিদা বেশি থাকায় রিকশার কাঠামো আগে থেকেই তৈরি রাখা হয়। অর্ডার পেলে ইঞ্জিন বসিয়ে দেওয়া হয়।
রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধে ওয়ার্কশপ ও চার্জিং পয়েন্ট বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আবার চলতি অর্থবছরে রিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারির ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। যেন ব্যাটারিচালিত রিকশাকে নিরুৎসাহিত করা যায়। তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
মন্তব্য করুন