দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়েছিল ২০২৪ সালের বর্ষায়। বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় এক নতুন প্রজন্ম, যারা মিছিলে ছিল, মাইক্রোফোনে ছিল। আর তাদের হাতিয়ার ছিল র্যাপ সংগীত, ব্যঙ্গাত্মক মিম এবং দেয়ালে আঁকা সাহসী গ্রাফিতি। খবর আলজাজিরার।
প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল সংস্কৃতি
আন্দোলনের শুরু হয়েছিল গান দিয়ে। সঙ্গে মাঠে নামে মিম আর গ্রাফিতি। তরুণদের কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে র্যাপার মোহাম্মদ সেজানের গান ‘কথা ক’। ১৬ জুলাই ঢাকায় ছাত্রদের ওপর পুলিশের দমনপীড়নের দিন মুক্তি পাওয়া এই গানে সেজান প্রশ্ন তোলেন: ‘কথা ক, দেশটা বলে স্বাধীন, তাইলে খ্যাচটা কই রে?’।
একই দিনে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আন্দোলনকারী আবু সাঈদ, যিনি পরে আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন।
র্যাপার হান্নান হোসেন শিমুলের ‘আওয়াজ উডা’ গানটিও ভাইরাল হয় আন্দোলনের সময়। গানটি বিক্ষোভে নতুন মাত্রা যোগ করে। জুলাই ও আগস্টজুড়ে এই গানগুলো পরিণত হয় মিছিলে মাইক্রোফোনের মতো, প্রতিরোধের প্রেরণায়।
রাজনৈতিক চর্চায় মিম ও ব্যঙ্গ
শুধু গান নয়, সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নানা ব্যঙ্গাত্মক মিম। সাংবাদিক ইমরান হোসেন একটি মিমে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’-এর পরিবর্তে লেখেন ‘মবোপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’, যেখানে সরকারের সিলের ভেতরে দেখানো হয় নির্যাতনের দৃশ্য। এই মিম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
১৮-১৯ জুলাই আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে বহু প্রাণহানির পর শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোস্টেশনের জন্য আবেগপ্রবণ বক্তব্য দিলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ‘নাটক কম করো পিও’ মিমটি। এই মিম তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
জার্মানির কোলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পুন্নি কবির বলেন, ‘হাসিনাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা একসময় ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ভয় কাটিয়ে মানুষ যখন প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ করতে শুরু করল, তখনই রাজনীতির পরিবর্তন নিশ্চিত হয়ে ওঠে।’
গ্রাফিতির দেয়ালে জেগে উঠেছিল জনতা
রাজপথের দেয়ালে লেখা হয়, ‘যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তুমিই বাংলাদেশ’, ‘হাসিনার সময় শেষ’, ‘গণহত্যা বন্ধ করো’। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘মানুষ নিজের কণ্ঠ ফিরে পেয়েছিল এই গ্রাফিতিগুলোতে। এগুলোর শক্তি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।’
আন্দোলনের ফল হিসেবে এক বছর পর, ২০২৫ সালের জুলাইতে সেজান প্রকাশ করেন নতুন গান ‘হুদাই হুতাশে’, যেখানে তিনি সমালোচনা করেন ক্ষমতায় আসা নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে, যারা আগে নিপীড়নের শিকার হলেও এখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে।
নতুন বাস্তবতায় মিম ও র্যাপ
আন্দোলনের সফলতার পর মিমের মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সব রাজনৈতিক দলই। একটি মিমে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ঘিরে পরিবারকেন্দ্রিক প্রশংসার ব্যঙ্গ করা হয়। ফেসবুক পেজ ‘উইটিজেনজি’ শিক্ষার্থীদের গড়া নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক নেতার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে ধরা হয় মিমে।
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী রাজনৈতিক বিশ্লেষক শাফকাত রাব্বী বলেন, ‘পশ্চিমে এক্স যা করে, বাংলাদেশে এখন তা করছে মিম আর ফটোকার্ড। এসব এখন রাজনৈতিক প্রতিরোধের কার্যকর হাতিয়ার।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক নোট ডিজাইনে গ্রাফিতির ব্যবহার প্রমাণ করে, এই মাধ্যমগুলো এখন দেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ।
র্যাপ এখন লাইফস্টাইল
গায়ক সেজান বলেন, ‘আমরা দায়িত্ববোধ থেকে গান করেছিলাম। এখন দেখি, র্যাপ বাংলাদেশের লাইফস্টাইলের অংশ হয়ে গেছে।’
হান্নান হোসেন শিমুলকে আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার করা হয়, তবে হাসিনার দেশত্যাগের পর তিনি মুক্তি পান। তার গানের একটি লাইন, ‘একটা মারবি, দশটা পাডাম, আর কয়ডারে মারবি তুই’, আজও আন্দোলনকারী তরুণদের মুখে মুখে ফেরে।
মন্তব্য করুন