রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই হাতের ডানপাশে একটি ভবন। যেখানে চলছে নিঃশব্দ এক যুদ্ধ- আচমকা যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ার সময় ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা চেষ্টা করছেন দুঃসহ ভয়াবহ সেই স্মৃতি ভুলে একটু একটু করে আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার। এই ভবনেই চলছে ট্রমা কাউন্সেলিং সেশন।
ভবনটির ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি বোর্ড, তাতে টানানো শিশু শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবি। কাঁচা হাতে আঁকা, কিন্তু নিঃসন্দেহে হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে আসা। কোনো ছবিতে আগুনে জ্বলছে একটি বিমান, নিচে আতঙ্কিত মানুষ। আরেক ছবিতে ভয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে স্কুল ড্রেস পরা ছোট্ট একটি মেয়ে। ছবিগুলোর পাশে সাঁটানো রয়েছে হাতে লেখা একটি চিরকুট। যাতে ফুটে উঠেছে রিমি নামে এক খুদে শিক্ষার্থীর হৃদয়ের কান্না—‘আমি আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসি মাছুকা মিস, আই লাভ ইউ।’ মাসুকা বেগম নিপু মাইলস্টোনের সেই প্রিয় শিক্ষক, যিনি বিমান দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন প্রাণ, তার প্রতিই এই ভালোবাসা।
ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাইমুনা এঁকেছে স্কুল ভবনের দিকে একটি বিমান এগিয়ে যাচ্ছে। আরেকজন শিক্ষার্থী নিঝুমও এঁকেছে এমনই একটি ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছে একটি লাল বিমান আঘাত করতে যাচ্ছে স্কুলের ভবনে। এসব কিছুই দুর্ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের মনে থাকা আতঙ্ক আর ভয়ের প্রতিচ্ছবি।
গত ২১ জুলাই উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণরত একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর থেকেই বন্ধ রয়েছে ক্লাস ও পরীক্ষা। তবে দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজের জন্য খোলা রয়েছে অফিসকক্ষ। গতকাল বুধবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায়, গোটা ভবনের আবহেই যেন ছড়িয়ে আছে আবেগঘন এক নীরবতা। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পর স্কুলটির কোলাহল থমকে গেছে। কোথাও নেই আগের সেই চঞ্চলতা, নেই টিফিন পিরিয়ডের আনন্দময় কোলাহল। তবে কাউন্সেলিংয়ের জন্য আসা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পাশাপাশি কিছু কৌতূহলী মানুষও প্রতিদিনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভেতরে ঢুকছেন। তারা মূলত বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার স্থানটি দেখার জন্যই আসছেন। এ ছাড়া আশপাশের এলাকার শিক্ষার্থীরাও ঘটনাস্থল দেখতে ক্যাম্পাসে ছুটে আসছেন।
অভিভাবক এবং শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোট্ট ছোট্ট শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে এখনো আতঙ্কের ছাপ- তারা যেন বুঝে উঠতে পারছে না, ঠিক কী ঘটেছিল। একজন কাউন্সেলর জানালেন, বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে কাঁদছে, কেউ কেউ আঁতকে উঠছে বিমানের শব্দে। এটা শুধু ভয় না, এটা স্থায়ী মানসিক আঘাত।
কাউন্সেলিং বিভাগের স্টাফ মো. আদনান জানান, গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অনেকেই এসেছিলেন কাউন্সেলিং করাতে। এর মধ্যে এক শিক্ষার্থীকে ৪৫ মিনিট কাউন্সেলিং করানো হয়। ভয় কাটানোর জন্য তার কাছে যখন মানসিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করা হয়, তখন সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। নিজের সহপাঠীদের হারানোর বেদনা কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
মোমিনুল নামে এক শিক্ষার্থী জানায়, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মুহূর্তে ছিল শ্রেণিকক্ষে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনেই দৌড়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। তখনই চোখের সামনে দেখতে পায়, তাদের জুনিয়র কয়েকজন শিক্ষার্থী আগুনে পুড়ছে। অশ্রুসজল চোখে মোমিনুল বলে, ‘আমি কিছুই করতে পারিনি। চোখের সামনে ছোট ভাইবোনদের আগুনে পুড়তে দেখেছি। সেই দৃশ্য আজও ভুলতে পারি না। কিছু করতে না পারার কষ্টটা এখনো মনে তীব্র হয়ে জেগে থাকে।’
মোমিনুল জানায়, প্রায় ১৫ মিনিটের মতো কাউন্সেলিং সেবা পেয়েছে। সেখানে কাউন্সেলররা তাকে পরামর্শ দিয়েছেন, যেন সে পছন্দের কাজগুলোতে নিজেকে বেশি বেশি ব্যস্ত রাখে। স্মৃতির মধ্যে নেতিবাচক না হয়ে যেন ইতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলোকেই বেশি মনে রাখে। আরও জানানো হয়, তার বয়স ও পরিস্থিতি বিবেচনায় সেদিন সে যে সাহস ও উদ্যোগ দেখিয়েছে, সেটাই যথেষ্ট।
খালেদা হোসেন নামে এক অভিভাবক জানান, তার মেয়ে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। সকালে স্কুল থেকে ফোন দেওয়ার তিনি তার সন্তানকে স্কুলে নিয়ে আসেন। ঘটনার সময় তার সন্তান স্কুলেই ছিল, এজন্য কাউন্সেলিং করানো লাগবে কি না সে বিষয়ে জানার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে এখনো ভয় পাচ্ছে। শুধু মেয়ে নয়, আমি নিজেও আতঙ্কে আছি। মানসিক ট্রমা বেশি হলে স্কুলে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।’
ঘটনার পর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে একটি অস্থায়ী চিকিৎসা শিবির চালু করেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। সেখানে বিমান দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্টাফদের প্রাথমিক চিকিৎসা, পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। যেসব ব্যক্তি মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত, তাদের কাউন্সেলিংয়ে পাঠানো হচ্ছে, প্রয়োজনে তাদের উন্নত মানসিক চিকিৎসার জন্য মানসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছেও পাঠানোর ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
বিমানবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, গতকাল মোট ১৭২ জনকে বিভিন্ন চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জনকে পাঠানো হয় কাউন্সেলিংয়ের জন্য। প্রয়োজনে মানসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছেও পাঠানো হবে। যতদিন পর্যন্ত প্রয়োজন হয়, এই চিকিৎসাসেবা ততদিন পর্যন্ত চলমান থাকবে।
এদিকে মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডিতে দগ্ধদের মধ্যে আরও একজনকে ছাড়পত্র দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তার নাম ফারজানা ইয়াসমিন (৪৫)। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা তিনি। এ ঘটনায় এখনো আইসিইউতে ভর্তি ২ জন। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘গত মঙ্গলবার আইসিইউতে ছিল ৩ জন। তবে তাদের মধ্যে একজনের শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় আজ (গতকাল) তাকে এইচডিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এখন মোট ৩২ জন রোগী ভর্তি আছে, যাদের মধ্যে ৩ জন ক্রিটিক্যাল ক্যাটাগরিতে আর তাদের চাইতে কম গুরুতর ৭ জন রয়েছে সিভিয়ার ক্যাটাগরিতে। বাকিরা অন্যান্য ওয়ার্ড ও কেবিনে ভর্তি রয়েছে। গত ৩ দিনে নতুন করে কোনো মৃত্যু নেই।’
ইনস্টিটিউটের পরিচালক জানান, ভর্তি থাকা ৩২ জনের মধ্যে ১৪ জনের শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। বাকিরা স্থিতিশীল রয়েছে। ঘটনার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত এসব রোগীর একেকজনকে একাধিকবারসহ সব মিলিয়ে ১৫৮টি ছোট-বড় অপারেশন করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন