জনবসতি এলাকায় কেমিক্যালের অবৈধ মজুত পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকাকে যে ভয়ংকর বোমায় পরিণত করেছে, নিমতলী ও চুড়িহাট্টার মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডই তার প্রমাণ। তবে মিরপুরের রূপনগরের মতো পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকাও যে ‘রাসায়নিক বোমা’ হয়ে আছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মঙ্গলবারের শিয়ালবাড়ির অগ্নিকাণ্ড।
এ ঘটনায় ১৬টি প্রাণ ঝরে যাওয়ার পর বরাবরের মতোই রাসায়নিকের অবৈধ গুদাম নিয়ে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। এর আগে ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা ভয়াবহ আগুনে ১২৪ প্রাণ যাওয়ার পরও ওই এলাকার অবৈধ গুদামগুলো সরাতে ঢাকার শ্যামপুর আর মুন্সীগঞ্জে ‘কেমিক্যাল পল্লি’ গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল।
তবে গত ১৫ বছরেও শেষ হয়নি সেই কাজ। মাঝে এই রাসায়নিকের আগুনেই বিভিন্ন এলাকায় গেছে আরও বহু প্রাণ।
রাজধানীর রূপনগরের আবাসিক এলাকার ৩ নম্বর সড়কের একটি দোতলা ভবনে গোপনে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘এম এস আলম ট্রেডিং’ নামে রাসায়নিকের গুদাম। মঙ্গলবার সেখান থেকে সৃষ্ট আগুন পাশের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় ছড়িয়ে নারীসহ ১৬ জন দগ্ধ হয়ে নিহত হন। দগ্ধ তিনজন এখনো জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
ভয়াবহ ওই ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষ বলছে, রাসায়নিকের গুদামটি ছিল অবৈধ। সেটি উচ্ছেদের জন্য তিনবার নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই নোটিশ যে পাত্তা পায়নি এবং এর বিরুদ্ধে কেউ আর ব্যবস্থাও নেয়নি, তা ১৬ জনের মৃত্যুর পর বেরিয়ে এলো। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুদামটিতে প্রাণঘাতী রাসায়নিকের মজুত ছিল।
রূপনগরের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রূপনগর ও আশপাশের এলাকায় কেমিক্যাল গুদামের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শিয়ালবাড়ি এলাকায় রাস্তার পাশে অনেক ভবনের নিচতলা ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছে কেমিক্যাল, পেইন্ট, প্লাস্টিক সামগ্রীর দোকান ও গুদাম হিসেবে। এসব গুদামে কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। নেই ফায়ার সেফটি, বাতাস চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, এমনকি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রও।
স্থানীয় বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন বলেন, আবাসিক এলাকায় এসব কেমিক্যাল গুদামের কারণে আমরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। সামান্য আগুন লাগলে পুরো এলাকা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এর উদাহরণ তো দেখাই গেল। একটি কেমিক্যাল গুদামের আগুনে ১৬ জন মারা গেল।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, শিয়ালবাড়ি এলাকার বেশকিছু কেমিক্যালের গুদাম চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো উচ্ছেদে কাজ শুরু হবে। সমস্যা হচ্ছে, এসব গুদামের কোনো নাম থাকে না। অবৈধ কেমিক্যাল রেখে তালাবদ্ধ করে রাখে। যখন তাদের দরকার পরে দরজা খুলে কেমিক্যাল বের করে নিয়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যা মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম জানান, সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে বিষয়টি জানানোর পাশাপাশি তিনবার ওই আগুন লাগা গুদামে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। ওই গুদামটি অভিযান চালানোর পর্যায়ে ছিল।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার ১১টা ৪০ মিনিট থেকে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করি। মঙ্গলবারই গার্মেন্টস অংশের আগুন নিয়ন্ত্রণ হয়। পাশে যে কেমিক্যালের গুদাম, যেটা আলম ট্রেডার্স নামে পরিচিত, সেই গুদামের আগুন আমরা বুধবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে নিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করেছি।
তবে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হলেও গতকালও আগুনের জায়গা থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। ধোঁয়ার সঙ্গে বের হচ্ছিল বিষাক্ত গ্যাস। সেই গ্যাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন দুর্ঘটনাস্থলের পাশের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। পরে তাদের উদ্ধার করে পাশের একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওই হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. মাহমুদুল হাসান জানান, বুধবার সকালে অগ্নিকাণ্ডস্থলের পাশের একটি পোশাক কারখানা থেকে অসুস্থ হয়ে অনেকেই এসেছিল। তাদের মধ্যে সাত-আটজন শ্রমিককে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বাকিদের অন্য হাসপাতালে যেতে বলা হয়। চিকিৎসা নিতে আসাদের একজন অচেতন ছিলেন। কারও কারও শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, কারও কাশি হচ্ছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ýবিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে রাজধানী ঢাকার বেশকিছু এলাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদাম উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। মিরপুরও ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদামের তালিকায় ছিল। কিন্তু উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি কেমিক্যালের সব গুদাম। এমনভাবে চলতে থাকলে এমন ট্র্যাজেডি আরও ঘটবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘ঢাকার মানুষ বসবাস করছে এক হিসেবে অ্যাটম বোমার সঙ্গে। এসব কেমিক্যাল সরানোর পদক্ষেপ বারবার ব্যর্থ হয়, আর আমাদের বারবার শ্রমজীবী ও আপনজনদের হারাতে হয়।
এদিকে, অগ্নিকাণ্ডে নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারকে ২ লাখ টাকা এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে, এ অগ্নিকাণ্ডে যারা জড়িত এবং অবৈধভাবে যারা কেমিক্যাল মজুত রেখেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ আহ্বান জানান।
অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের পরিবারকে ১ লাখ করে টাকা দেবে বিএনপি: রূপনগরে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ১ লাখ করে টাকা দেবে বিএনপি। মঙ্গলবার রাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে এ ঘোষণা দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ ঘটনাকে ‘বেদনাদায়ক’ উল্লেখ করে তিনি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানান।
নিহতদের পরিবারকে ১ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি এনসিপির: রূপনগর আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গুদাম ও পোশাক কারখানায় আগুনে নিহতদের প্রতিটি পরিবারকে এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর স্বাধীনতা চত্বরে এনসিপি মিরপুর জোনের প্রতিবাদ সভায় এ দাবি জানানো হয়।
মহিলা পরিষদের শোক: রূপনগর শিয়ালবাড়ি এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জন পোশাক কর্মীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সংগঠনটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, এর আগে সংঘটিত বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটির যে সুপারিশগুলো করা হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের গাফিলতিই এ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। মহিলা পরিষদ জনবসতিপূর্ণ এলাকায় দাহ্য ও বিস্ফোরক পদার্থের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও সংরক্ষণ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শ্রমজীবী মানুষের কর্মস্থলে জীবন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতি ও বাস্তবায়ন কাঠামো গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে।
মন্তব্য করুন