

তিনশ আসনে ৩০০ প্রার্থীও মিলবে না—এমন তীর্যক মন্তব্যও এক সময় শুনতে হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি); কিন্তু মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরুর পর সেই ধারণা বদলে দিয়েছে তরুণ নেতৃত্বের এ নতুন রাজনৈতিক দলটি। ফরম বিক্রি শুরুর পর থেকেই এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় মুখর হয়ে ওঠে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পদচারণায়। দলীয় নেতাদের পাশাপাশি শ্রমিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, আলেমসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ফরম নিতে দেখা যায়। দলীয় সূত্র বলছে, তিনশ আসনে প্রায় দেড় হাজার সম্ভাব্য প্রার্থী এরই মধ্যে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এনসিপির হয়ে নির্বাচনে লড়তে চান তারা।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ৬ নভেম্বর থেকে আগ্রহী প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করে এনসিপি। ফরম বিতরণ শুরু হওয়ার দিন থেকেই প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মিছিল সহকারে কার্যালয়ে আসেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। পরে মানুষের আগ্রহ দেখে মনোনয়ন ফরম বিক্রির সময় বাড়ায় দলটি। গতকাল বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে সে সময়। দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেতারা জানিয়েছেন, প্রায় ১ হাজার ৫০০ ফরম বিক্রি হয়েছে। এনসিপির নেতারা ছাড়াও জুলাই যোদ্ধা, সাবেক আমলা, অধ্যাপক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন বলে জানান তারা। গতকাল মনোনয়ন ফরম কিনেছেন জুলাইয়ের আইকনিক স্যালুট হিরোখ্যাত সেই রিকশাচালক সুজন। দলের যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও মিডিয়া সেলের সদস্য খান মুহাম্মদ মুরসালীন বলেছেন, আমরা জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে চেষ্টা করছি জুলাইয়ে যুদ্ধ করা সব বর্গের মানুষকে মনোনয়ন দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে। এনসিপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ শুক্র ও আগামীকাল
শনিবার দলীয় কার্যালয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। বিশেষ করে একই আসনে একাধিক হেভিওয়েট মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আগে ডাকা হবে। সাক্ষাৎকারে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পাশাপাশি দলের আহ্বায়ক, সদস্য সচিবও থাকতে পারেন। সব ঠিক থাকলে চলতি মাসের মধ্যেই প্রথম ধাপে ১০০ থেকে ১৫০ আসনে প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে।
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক ও কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী কালবেলাকে বলেন, আমাদের মনোনয়ন ফরম বিতরণের সময় শেষ হয়েছে। আগ্রহভরে সবাই ফরম কিনেছেন। আগামীকাল (আজ) থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্য থেকে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হবে। আমরা আশা করছি, চলতি মাসেই প্রথম ধাপের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করতে পারব।
এত এত আগ্রহীদের মধ্য থেকে কীভাবে প্রার্থী বাছাই করা হবে—জানতে চাইলে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, মানুষ আগ্রহভরে ফরম কিনেছেন। চিকিৎসক, শিক্ষক, আলেমসহ সব শ্রেণির মানুষ ফরম নিচ্ছেন। এলাকায় মানুষের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা আছে, মানুষের জন্য এতদিন ধরে কাজ করেছেন এবং তাদের এলাকায় ফাইট দেওয়ার বা জিতে আসার সম্ভাবনা আছে, সে সম্ভাবনার ভিত্তিতে আমরা প্রার্থী করব। তবে শুধু সংসদ সদস্য প্রার্থী বাছাই নয়, আমরা একই সঙ্গে প্রার্থীদের নিয়ে একটা ডাটাবেজ তৈরি করছি। ভালো প্রার্থীদের আমরা বিভিন্ন জায়গায় কাজে লাগাব। কেউ মেয়র নির্বাচন করবেন, কেউ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করবেন, কেউ কাউন্সিলর নির্বাচন করবেন, অর্থাৎ যাকে যেখানে প্রয়োজন কিংবা যোগ্য তাকে সেখানেই আগামীতে প্রার্থী করা হবে।
শুধু এনসিপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন প্রার্থীদের নিয়েই নির্বাচনী রণকৌশল সাজাতে চাচ্ছে না দলটি। বরং সমাজের ভিন্ন ভিন্ন পেশায় ক্লিন ইমেজের জনপ্রিয় প্রার্থীদের ভোটের ট্রেনে সওয়ার করাতে চায় এনসিপি। যেখানে প্রার্থী হবেন রিকশাচালক থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাও। বিএনপি এবং জামায়াতের মনোনয়নবঞ্চিতদের অনেকেই থাকতে পারেন এনসিপির প্রার্থী তালিকায়। এনসিপির নির্বাচনী পরিচালনা সমন্বয় কমিটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় চমক দেখাবেন তারা। সমীকরণ মেলাতে পারলে সরকার গঠন, না হলে শক্তিশালী বিরোধী দলেই জায়গা হবে এনসিপির—এমন দাবিও করেছেন তারা।
নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি ডা. তাসনিম জারা বলেন, অনেক পেশার মানুষ যারা আগে রাজনীতিতে যুক্ত হবেন কিংবা জায়গা হবে চিন্তা করেননি তারা আগ্রহ প্রকাশ করছেন। অধ্যাপকরা আসছেন, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী এসেছেন। তারা চাচ্ছেন, প্রক্রিয়াটাতে যুক্ত হতে। রিকশাচালক, শ্রমিক সব শ্রেণির মানুষকে আমরা যুক্ত করতে চাই। আশা করছি, সবাইকে নিয়ে সুন্দর একটা জায়গা তৈরি করতে পারব।
বিএনপি-জামায়াতের মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষুব্ধ এমন প্রার্থীদের জন্য এনসিপির দুয়ার খোলা রেখেছে। এরই মধ্যে এমন একাধিক ব্যক্তি এনসিপির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন দলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনি বলেন, আমরা ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সেখানে অবশ্যই চমক থাকবে। বিএনপি এবং জামায়াতের মনোনয়নবঞ্চিত যারা আমাদের সঙ্গে নির্বাচন করতে আগ্রহী, তাদেরও একটা অংশ চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় থাকবেন।
তিনি জানান, আগামী নির্বাচনে এনসিপির লক্ষ্য সরকারি দল হওয়া। তা নাহলে নিদেনপক্ষে শক্তিশালী বিরোধী দল হওয়ার ভাবনা আমাদের আছে। বড় দুটি দলের মধ্যে জুলাই সনদে ‘হ্যাঁ’ এর পক্ষে যে দল থাকবে, তাদের সঙ্গে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট কিংবা আসন সমঝোতাও হতে পারে।
এদিকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরিচিত মুখ ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং মাজফুজ আলমের এনসিপিতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আশা রাখছে দলটি। তবে, ফ্যাসিবাদবিরোধী অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দল থেকে এ দুই উপদেষ্টা নির্বাচনে অংশ নিলে এনসিপি সেটা ইতিবাচকভাবে দেখবে—এমন কথাও জানান সারজিস আলম।
অবশ্য এনসিপি এককভাবে নির্বাচনের দিকেই এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গত বুধবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, আমরা এককভাবে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। সে লক্ষ্যে সব কটি আসনেই শাপলা কলির জন্য প্রার্থী দেওয়ার কাজ করছি। সমঝোতা বা জোট রাজনৈতিক বা আদর্শিক জায়গা থেকে হতে পারে। জুলাই সনদ ও আমাদের সংস্কারের দাবিগুলোর সঙ্গে যদি কোনো দল ঐক্যবদ্ধ বা সংহতি প্রকাশ করে, সে ক্ষেত্রে জোটের বিষয়টি বিবেচনা করা হতে পারে। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত এককভাবেই এগোচ্ছি। এ মাসের মধ্যে (নভেম্বর) আমরা আমাদের প্রার্থীদের তালিকাও চূড়ান্ত করব। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা মানুষের কাছ থেকে যে সাড়া ও সমর্থন পেয়েছি, আগামী নির্বাচনেও সেই প্রতিফলন পাব বলে প্রত্যাশা করি।
কেন্দ্রীয় নেতারা যেসব আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন: এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঢাকা-১১ ও দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন রংপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচনে লড়বেন। দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ঢাকা-১৮, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম পঞ্চগড়-১, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ কুমিল্লা-৪, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ভোলা-১, সারোয়ার তুষার নরসিংদী-২, আব্দুল হান্নান মাসুদ নোয়াখালী-৬, আরিফুল ইসলাম আদীব ঢাকা-১৪ আসন থেকে লড়বেন। ঢাকা-৮ থেকে অ্যাডভোকেট তরিকুল ইসলাম, ঢাকা-৯ থেকে লড়তে পারেন ডা. তাসনিম জারা। এ ছাড়া ঝালকাঠি-১ থেকে ডা. মাহমুদা মিতু, কক্সবাজার-২ আসন থেকে এ এস এম সুজা উদ্দিন, কুমিল্লা-১০ থেকে জয়নাল আবেদীন শিশির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ থেকে আতাউল্লাহ, গাজীপুর-৬ থেকে ইঞ্জিনিয়ার ফরহাদ সোহেল, ময়মনসিংহ-৪ থেকে ডা. জাহেদুল ইসলাম, ময়মনসিংহ-৯ থেকে আশেকীন আলম, সিরাজগঞ্জ-৬ থেকে এস এম সাইফ মোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম-৩ থেকে ডা. আতিক মুজাহিদ নির্বাচনে লড়তে যাচ্ছেন।
মন্তব্য করুন