

মশাবাহিত ডেঙ্গু এখন বছরজুড়ে ভোগান্তির নাম। ডেঙ্গু নিয়ে বছরজুড়েই শনাক্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ডিসেম্বরের এখনো অর্ধেক বাকি। এর মধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা লাখে পৌঁছেছে। সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় শহর থেকে গ্রাম সবখানেই রোগীর ঢল। মশাবাহিত এ রোগে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন কর্মক্ষম মানুষ। চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর ৭৮ শতাংশের বেশি ১৬ থেকে ৬০ বছর বয়সী। এ বিপুল কর্মক্ষম মানুষ রোগটি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় একদিকে দেশের উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। ১৬ থেকে ৬০ বছর বয়সী রোগীর সংখ্যা ৭৮ হাজার ১৪৫ জন। শিশু রয়েছে ১৬ হাজার ৪০৭ জন। ১৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী রোগী ৫৮ হাজার ৩৩৯ জন এবং ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী রোগী ১৯ হাজার ৮০৬ জন।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেন, এ বছর নীরবে ডেঙ্গু মহামারি হিসেবে সংক্রমিত হয়েছে। কিন্তু এ জ্বরকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না। অথচ প্রতিরোধ্য মশাবাহিত এ রোগ দেশের উৎপাদনশীলতায় ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। এত বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। রোগটি প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নয়তো আগামীতে আরও বেশি মানুষ ডেঙ্গু পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে পারে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে এডিস মশা নির্মূলের বিকল্প নেই। তবে, আমরা এখনো সেই কাজটি সঠিকভাবে করতে পারিনি। ফলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না, অথচ এটি সম্ভব। ডেঙ্গুকে মৌসুমি রোগ ভেবে হালকাভাবে দেখার সময় শেষ। তিনি বলেন, কর্মক্ষম মানুষের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি কারণ—এ মানুষগুলো জীবিকার জন্য বাইরে বের হয়। বিভিন্ন পরিবেশে চলাফেরা ও কাজ করার ফলে মশার কামড়ের ঝুঁকিও তাদের তুলনায় বেশি থাকে। তাই কর্মক্ষম মানুষ বেশি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৯৯ হাজার ৬৯৩ জন। যার মধ্যে ৬২ হাজার ২৫৯ জন পুরুষ এবং ৩৭ হাজার ৪৩৪ জন নারী। এখন পর্যন্ত ৯৭ হাজার ৮৬৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। চলতি মৌসুমে ডেঙ্গুতে মৃত ৪০৪ জনের মধ্যে ২১১ জন পুরুষ এবং ১৯৩ জন নারী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯০ জন মারা যান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়। ঢাকা উত্তরে মারা যান ৬৭ জন, বরিশালে ৪৮, চট্টগ্রামে ৩১, ময়মনসিংহে ২৪, রাজশাহীতে ২০, খুলনায় ১৩, ঢাকা বিভাগের অন্যান্য অঞ্চলে ৯ এবং সিলেটে ২ জন। চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে বরিশাল বিভাগে ২১ হাজার ১৯১ জন। আর সবচেয়ে কম শনাক্ত হয়েছে সিলেট বিভাগে ৪০৯ জন।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে নভেম্বর মাসে ১০৪ জন। তার আগে অক্টোবর মাসে মারা যান ৮০ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৭৬ জন। আগস্টে ৩৯ জন, জুলাইয়ে ৪১, জুনে ১৯, মে মাসে ৩, এপ্রিলে ৭, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন এবং জানুয়ারিতে ১০ জনের মৃত্যু হয়। মার্চ মাসে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। চলতি ডিসেম্বর মাসে এখন পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে, জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩, জুনে ৫ হাজার ৯৫১, আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে ১৫ হাজার ৮৬৬ জন, অক্টোবরে ২২ হাজার ৫২০, নভেম্বর মাসে ২৪ হাজার ৫৩৫ জন এবং ডিসেম্বরের প্রথম ১২ দিনে ৫ হাজার ২৯৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা যান ৪০৪ জন। তাদের মধ্যে ০ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু মারা গেছে ৭০ জন। আর একই বয়সসীমার মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৬ হাজার ৪০৭ জন শিশু।
ডেঙ্গুর সর্বশেষ চিত্র অনুযায়ী, মৃত্যুহীন এক দিনে ডেঙ্গু নিয়ে আরও ২০০ জন মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। একই সময়ে ২১৬ জন রোগী ছাড়পত্র পেয়েছে। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৯৯ হাজার ৬৯৩ জন এবং ছাড়পত্র পেয়েছে ৯৭ হাজার ৮৬৯ জন। মারা গেছে ৪০৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, গতকাল এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ২৪ জন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ২৫ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, বরিশালে ১৫, চট্টগ্রামে ৭৭, ঢাকা বিভাগের অন্যান্য অংশে ৩২ এবং ময়মনসিংহে ২৭ জন। এ ছাড়া দুজন ডেঙ্গু রোগী অন্যান্য বিভাগে ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে ৯৯ হাজার ৬৯৩ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। একই সময়ের মধ্যে ৯৭ হাজার ৮৬৯ জন হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে এবং মারা গেছে ৪০৪ জন। মৃত্যুর মধ্যে ৫২ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ নারী।
২০০০ সালে ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং মারা যান ৯৩ জন। ঘটনা তখন সাধারণ মানুষের কাছে নতুন ছিল। দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা প্রকট আকার নেয় ২০১৯ সালে। সে বছর এক লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ১৭৯ জন, যা তখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ছিল। তবে চার বছর পর, ২০২৩ সালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। ইতিহাসের সর্বাধিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর রেকর্ড তৈরি হয় সে বছর, যা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য বড় সতর্ক সংকেত হিসেবে চিহ্নিত হয়। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ শনাক্ত ও মারা যায়। সে বছর ডেঙ্গু শনাক্ত হয় তিন লাখের বেশি মানুষের শরীরে এবং মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয় ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মারা যায় ৫৭৫ জন।
মন্তব্য করুন