দিন যত যাচ্ছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ততই খারাপ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। চলতি বছর ২৬৭ দিনে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৯০৯ জন। সর্বশেষ গতকাল রোববার মারা গেছেন ১৬ জন। এ ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ৮ জন। মৃতদের মধ্যে ৪৯ শতাংশের বয়স ২১ থেকে ৫০ বছর। ডেঙ্গুতে শুধু চলতি মাসে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৩১৬ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ উপার্জনক্ষম, যাদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবার।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শোলক ইউনিয়নের ছেলে সুজন (২৯) পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন। মাঝেমধ্যে মাছ ধরেও জীবিকা নির্বাহ করতেন। দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। বড় মেয়ের বয়স পাঁচ বছর ও ছোট মেয়ের বয়স ১৮ মাস। চলতি মাসের শুরুতে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। পাঁচ দিন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু ডেঙ্গুর কাছে হার মানতে হয়। এতে সুজনের পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকার। দুই শিশুকন্যা নিয়ে এখন পথে বসার উপক্রম তার পরিবারের সদস্যদের।
স্বজনরা জানান, গত ৫ সেপ্টেম্বর জ্বরে আক্রান্ত হন সুজন। স্থানীয় ধামুরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরীক্ষায় ধরা পড়ে ডেঙ্গু। সেখানে চিকিৎসাধীন থেকে তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ৯ সেপ্টেম্বর বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। সুজনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী সুমী বলেন, সুজনের পরিবারে আয় করার মতো আর কেউ রইল না।
শুধু সুজনের পরিবার নয়, স্বজন হারা শোকে মুহ্যমান এমন সহস্রাধিক পরিবার। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বেসরকারি অসংখ্য হাসপাতালের তথ্য এখনো আসে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সার্ভারে। তাই পুরোপুরি হিসাব দেওয়া সম্ভব হয় না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে চলতি বছর এ পর্যন্ত ৯০৯ জনের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে অন্তত অর্ধেক মানুষ ছিল উপার্জনক্ষম, যাদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল পরিবার। ডেঙ্গু তাদের পরিবার তছনছ করে দিয়েছে। একশরও বেশি শিশুর মৃত্যুতে বাবা-মা পাগলপ্রায়। সন্তান হারা পরিবার মানসিক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমাদের দেশে ডেঙ্গু বিস্তারের ইতিহাস ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে চলতি বছর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এজন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঘরে ঘরে জ্বরের প্রকোপ। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষকে ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মশক নিধনের কয়েল, অ্যারোসল, মশারিসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়েছে। জ্বর-সর্দি তথা ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে মানুষের ভিড় লেগেই রয়েছে। এদিকে ডেঙ্গু চিকিৎসায় দেশজুড়ে ব্যবহৃত আইভি ফ্লুয়েড স্যালাইনের রয়েছে তীব্র সংকট। রোগীর পরিবারকে চড়া মূল্যে স্যালাইন কিনতে হয়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ নিঃস্ব প্রায়।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাত দিন ভর্তি থাকার পর ছাড়পত্র নিয়েছেন গৃহকর্মী সালেহা বেগম (৫০)। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ভাড়া বাসায় সংসার। স্বামী দিনমজুর আয়নাল মিয়া দুই বছর আগে ক্যান্সারে মারা যান। ছেলে ইদ্রিস ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান আর মেয়ে শারমিন এইচএসসি পাস করেছে। মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ইদ্রিস নিয়মিত রিকশা চালাতে পারেননি। ওষুধ, স্যালাইন, খাবার ও অন্যান্য জিনিপত্র কিনতে গিয়ে পরিবারটি এখন ঋণী। সালেহা বেগম কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হয়েছি, কিন্তু ১৫ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়েছে। আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য এই টাকা অনেক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৯০৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫২০ জন নারী আর ৩৮৯ জন পুরুষ। ১৫ বছরের নিচে ১০৫ শিশুর মৃত্যু হয়। ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সী ৫৯ কিশোর-যুবকের মৃত্যু হয়। ২১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ৪৪৪ জন প্রাণ হারান। ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী ১৩০ জন। ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সী ১০৬ জন। ৭১ থেকে ৮০ বছর বয়সী ৪৫ আর ৮০ তদূর্ধ্ব ২০ জন। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হিসাবেও কর্মক্ষম মানুষ সবচেয়ে বেশি।
এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের ৫৬ শতাংশ ২১ থেকে ৫০ বছর বয়সী। জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে ১ হাজার ৩৬, জুনে ৫ হাজার ৯৫৬, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার, আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ এবং চলতি মাসের গত ২৪ দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৩ হাজার ৯১৭ জন। গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর আগের বছর ২৮ হাজার ৪২৯, ২০২০ সালে ১ হাজার ৪০৫ জন। ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। আর ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার বলেন, ডেঙ্গুতে এ বছর মধ্যবয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকা সিটিতে। এর বাইরে ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী এসব জেলায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম এবং লক্ষ্মীপুর জেলা এবং বরিশাল বিভাগের বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক বেশ কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। কিন্তু কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। পাঁচ শতাধিক কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু মানে তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো নিঃস্ব। এ বছর কেন যুবক ও কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু ও আক্রান্ত বেশি হচ্ছে, সেটি জানতে হলে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা (ডেথ রিভিউ) জরুরি। কিন্তু ডেঙ্গুর উচ্চ সংক্রমণ ঘটলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজটি এখনো শুরু করতে পারেনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা।
ডেথ রিভিউ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবিরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন, পরে ফোন করবেন বলে খুদে বার্তায় জানান। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামের ব্যক্তিগত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
মন্তব্য করুন