শাহনেওয়াজ খান সুমন
০২ অক্টোবর ২০২৩, ০২:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকায় ঘরহীন দেড় কোটি মানুষ

ঢাকার একটি বস্তি এলাকা। ছবি : সংগৃহীত

দুই যুগ আগে জীবিকার তাগিদে গাইবান্ধা থেকে রাজধানী ঢাকায় আসেন আমিরুল ইসলাম। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। থাকেন লালবাগের ছোটখাটো একটি ভাড়া বাসায়। দীর্ঘদিন ঢাকায় থাকলেও ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ি কোনোটাই কিনতে পারেননি। তিনি বলেন, সরকারি আবাসন প্রকল্পের উচ্চমূল্য। ঋণও সহজে পাওয়া যায় না। আর যা বেতন পাই, সন্তানদের লেখাপাড়া আর সংসার চালাতেই ফুরিয়ে যায়।

আমিরুলের মতো কর্মজীবী অনেকেই স্বপ্ন দেখলেও রাজধানীতে নিজস্ব আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ মানুষ নিজের বাসাবাড়িতে বাস করেন। বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের নিজের ঘর নেই। সে হিসাবে ঢাকায় ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের নিজের ঘর নেই। সরকারি হিসাবে রাজধানীর জনসংখ্যা ২ কোটি ১০ লাখ হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী ১ কোটি মানুষের নিজস্ব কোনো বাসস্থান নেই। বিপুলসংখ্যক মানুষকে ভাড়া বাসায়, সরকারি বাসায় কিংবা বস্তিতে বসবাস করতে হয়। সবার জন্য আবাসন নিশ্চিতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন না। সরকারি সুবিধাভোগীদের বেশিরভাগই সম্পদশালী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। তবে বাস্তুহারা মানুষের জন্য রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প।

এমন পটভূমিতে আজ সোমবার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বসতি দিবস। ১৯৮৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪০তম অধিবেশনের সিদ্ধান্তের আলোকে প্রতিবছরের অক্টোবরের প্রথম সোমবার বিশ্ব বসতি দিবস পালন করা হয়। এবার দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য—‘বৈষম্য হ্রাসের অঙ্গীকার করি, সবার জন্য টেকসই নগর গড়ি’। দিবসটি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বাণী দিয়েছেন। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন, নদীভাঙনসহ বিবিধ কারণে রাজধানীতে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এসব মানুষের রাজধানীতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হচ্ছে না। তারা বস্তি, ফুটপাত, বাস-লঞ্চ-ট্রেন স্টেশনে বাস করছেন। ভাসমান মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্যা, নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে ঢাকায় আসেন তারা। চাকরি ও থাকার স্থান না পেয়ে বেশিরভাগের ঠাঁই মিলছে রাস্তায়। শুধু কারওয়ান বাজার এলাকায় হাজারো ভাসমান মানুষের বাস। তারা দিনের কর্মব্যস্ততার পর বিভিন্ন আড়তে দলবদ্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। সন্ধ্যা নামলেই প্রধান সড়কের পাশের আইল্যান্ডের ওপর নিজেদের সবজি টানার ঝুড়িতে ঘুমিয়ে পড়েন। কেউবা ভ্যানের ওপর, রেললাইনের পাশে, নয়তো বিভিন্ন অফিসের নিচে। এভাবেই চলে ভোর রাত পর্যন্ত। কয়েক হাজার ভাসমান মানুষ শুধু কারওয়ান বাজারের ফুটপাতেই জীবনযাপন করেন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, যাদের আয় ২০ হাজার টাকার মধ্যে, তারা সংসার চালাতে খরচ কাটছাঁট করছেন। থাকছেন ঝুপড়ি ঘরে। সাবলেট বেড়েছে উল্লেখযোগ্যহারে। বাড়তি খরচ থেকে বাঁচতে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে ব্যাচেলর জীবনযাপন করছেন অনেকে। বড় সাইজের ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেছে নিচ্ছেন ছোট ফ্ল্যাট। ঢাকায় আবাসনেই আয়ের অর্ধেক চলে যাচ্ছে সাধারণের। এতে সংসারে খরচ চালাতে গিয়ে শিক্ষা-স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকায় যাদের আয় ২০ হাজার বা ২০ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ভরসা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে কোনো ঝুপড়ি ঘর। এ ঘরে পরিবার নিয়ে কোনোরকমে থাকছেন তারা। যাদের আয় ২১ থেকে ৩০ হাজার টাকা, তারা থাকছেন ৬ থেকে ১০ হাজার টাকায় সাবলেট। ৩১ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয়কারীরা থাকছেন ছোট আকারের কোনো ফ্ল্যাটে। যেগুলোর ভাড়া ১১ থেকে ১৪ হাজার টাকার মধ্যে। আর যাদের আয় ৪১ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে, তারা থাকছেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ফ্ল্যাটে। যেগুলোর আয়তন ১১০০ থেকে ১১৫০ স্কয়ার ফুট। আর ৫১ থেকে ৮০ হাজার টাকা আয়ের মানুষের ভরসা ১১৫০ থেকে ১২০০ স্কয়ার ফুটের কোনো ফ্ল্যাট, যেগুলোর ভাড়া ২১ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে। ৮০ থেকে ১ লাখ টাকা আয়ের মানুষ থাকছেন ১২০০ থেকে ১৫০০ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাটে—যেগুলোর ভাড়া ৩১ থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে। তবে ভালো মানের ১৫০০ স্কয়ার ফুট বা তার চেয়ে একটু বড় কোনো বাসায় থাকতে হলে অবশ্যই ১ লাখ টাকার বেশি তাকে আয় করতে হবে। যেগুলোর ভাড়া ৪০ হাজার টাকা বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি।

রিহ্যাব সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, সরকার স্বাস্থ্য-চিকিৎসা-শিক্ষা খাতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এসব মৌলিক চাহিদার মতো বাসস্থানও একটি। রাজধানীবাসীর আবাসনের জন্য সরকার এ খাতে কখনো ভর্তুকি দেয়নি। এমনকি স্বল্প সুদে দেয়নি ঋণও। সরকারের উচিত ছিল স্বল্প সুদে ঋণ ও লো কস্ট হাউজিং নির্মাণ করে বরাদ্দ দেওয়া। অল্পসংখ্যক লো কস্ট হাউজিং তৈরি করলেও চাহিদার চেয়ে তা অনেক কম। এজন্য রাজধানীর বিপুলসংখ্যক মানুষের নিজের ঘর নেই।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানীতে কিছু মানুষ ভাড়া বাসায় থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে ঢাকায় এটি একেবারেই ভারসাম্যহীন। এখানে নিজস্ব বাসস্থানহীন মানুষ ৭০ শতাংশেরও বেশি। এর মধ্যে রয়েছেন নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ এবং বস্তিবাসী। এসব মানুষের পক্ষে নিজস্ব আবাসনের ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাদের আয়ের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই চলে যাচ্ছে আবাসন খরচে। ফলে তারা যুগের পর যুগ নিজস্ব আবাসনের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। সরকারের যে হাউজিং পলিসির প্রয়োজন ছিল, সেখানে একটি ঘাটতি রয়ে গেছে।

রাজউকের ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমরা মধ্যবিত্তদের জন্য ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এলাকাভিত্তিক এক লাখ অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা করছি। এটি আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারব। তিনি বলেন, এর বাইরে পূর্বাচলে ২০ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট করব। এগুলো কম ভাড়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষকে দেওয়া হবে। এসব অ্যাপার্টমেন্ট যারা কিনতে চান, তাদের দীর্ঘমেয়াদি কিস্তি সুবিধা দেওয়া হবে। এ উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে উৎসাহ দিচ্ছি। প্রকল্পে সরকার স্বল্প সুদহারে ঋণের ব্যবস্থা করবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইউজিসির খণ্ডকালীন সদস্য হলেন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম

মিরপুর টেস্টের টিকেট মূল্য প্রকাশ, যেভাবে পাওয়া যাবে 

তীব্র গতিতে উপকূলে আছড়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘মিগজাউম’

ক্যাম্পাসে নোবিপ্রবি ফিল্ম সোসাইটির সিনেমা প্রদর্শন

ইউটিউবে ভিডিও বানাতে গিয়ে বিমান বিধ্বস্ত, ৬ মাসের জেল

বুটেক্সে সেমিস্টার শেষ ৯ মাসে, হয়নি ফলাফল

সংসার করার মতো লোকের অনেক অভাব : হুমায়রা সুবহা

কমবে ঢাকার তাপমাত্রা, হতে পারে বৃষ্টি

শরিকদের আশার বাণী শোনালেন তথ্যমন্ত্রী

যশোরে এসিল্যান্ড পরিচয়ে মোবাইলে প্রতারণা

১০

মেসির মায়ামিতেই অনুষ্ঠিত হবে কোপার ফাইনাল

১১

জবির নতুন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবীর

১২

ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের টানেল ধ্বংসে ইসরায়েলের ভয়ংকর কৌশল!

১৩

বিদেশিদের চাপ একেবারেই নেই : ইসি আলমগীর

১৪

না ফেরার দেশে ‘সিআইডি’র ফ্রেডি

১৫

সরকার আশ্বাস দিয়েছে বলেই নির্বাচনে এসেছি : জাপা মহাসচিব

১৬

এবার দক্ষিণ গাজা খালি করতে চায় ইসরায়েল

১৭

আসন ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত কবে, জানালেন কাদের

১৮

নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান ঠেকাতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে বিজিবি

১৯

শুরু হলো এপিকটা অ্যাওয়ার্ড-২০২৩

২০
X